নারী মানেই ভালোবাসা, সেবাযত্ন কিংবা স্নেহ মমতার আধার। নারীরা ভীষণভাবে তার পরিবার কিংবা কাছের মানুষদের আগলে রাখতে জানেন। নারীদের স্বভাব হচ্ছে সবার প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং নিজের প্রতি চূড়ান্ত বেখেয়াল হওয়া। নারীরা পরিবারের সদস্যদের অসুখবিসুখে দিনরাত এক করে তাদের সেবাযত্ন করেন। কিন্তু নিজে অসুস্থ হলে তা একদম পাত্তাই দিতে চান না। এই বেখেয়ালি হওয়ার ফলাফল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভালো হয় না। তাছাড়া নারীরা ঘরে-বাইরে এত ব্যস্ত থাকেন যে, চাইলেও খুব একটা যত্নবান হতে পারেন না নিজের প্রতি। যারা আমাদের জন্য এত নিবেদিতপ্রাণ, তাদের প্রতি যত্নশীল হওয়া আমাদের কর্তব্য। সাধারণত নারীর বয়স ৩০-৪০ পেরোলে তার শরীরে বিভিন্ন ধরনের অসুখ বাসা বাঁধে। অনেক সময় খাদ্যাভ্যাসের অনিয়মের জন্য আরও অল্প বয়সেই তারা নানাবিধ অসুখে আক্রান্ত হন। নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতায় কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা অবশ্যই জরুরি। চলুন সেসব পরীক্ষা সম্পর্কে নিই।
থাইরয়েড ও কোলেস্টেরল
বর্তমান সময়ে নারীদের অনেক বেশি থাইরয়েডের সমস্যা দেখা যায়। কিছু নারী হাইপোথ্যারয়ডিজমে ভোগেন আবার কিছু হাইপারথ্যারয়ডিজমে। বিশেষ করে হাইপোথাইরয়েড অসুখটি নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। পা ফোলা, হাত-পা ও জয়েন্টগুলোয় ব্যথা থাইরয়েড সমস্যার সাধারণ উপসর্গ। এ ছাড়া অতিরিক্ত ওজন থাকলেও থাইরয়েডের পরীক্ষা করানো উচিত। বয়স ৩০ হলেই বছরে অন্তত দুবার থাইরয়েড পরীক্ষা করানো দরকার। পাশাপাশি রক্তের কোলেস্টেরল পরীক্ষা করাতে হবে। লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষার মাধ্যমে কোলেস্টেরলের মাত্রা জানা যায়।
হাড়ের ঘনত্ব
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাড়ের ক্ষয় শুরু হতে থাকে। বিশেষত নারী শরীরের। হাঁটুর সমস্যা তো সবারই হয় কমবেশি। তবে হাড় ক্ষয় নারীদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ রোগ। ভিটামিন ডি-এর অভাবে হাড় ক্ষয় এবং অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়ে। তাই বয়স ৩০ পেরিয়ে গেলেই ভিটামিন ডি৩ টেস্ট করাতে হবে। ত্রিশ বা চল্লিশোর্ধ্ব নারীদের ভিটামিন ডি-এর বেশি প্রয়োজন, যা ক্যালসিয়াম শোষণ করে এবং হাড়ের ক্ষয় রোধ করে। তাই ভিটামিন ডি-এর মাত্রা পরীক্ষা করা খুবই প্রয়োজন। একই সঙ্গে ক্যালসিয়াম, বোন ডেনসিটি টেস্টও করতে হবে। অনেকে আবার ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যায় ভোগেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে গাউট আর্থ্রাইটাস ধরা যায়।
ডায়াবেটিস ও প্রেশার
বর্তমানে যেকোনো বয়সেই ডায়াবেটিস হতে পারে। চল্লিশোর্ধ্ব নারীরা টাইপ-টু ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হন। শরীর গ্লুকোজের সমতা বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না। তাই ডায়াবেটিস প্রতিরাধ করতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ভীষণ জরুরি। যাদের পরিবারে ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের বয়স ৩০ পেরিয়ে গেলেই নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে হবে। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমও প্রয়োজন। এ ছাড়া মাসে অন্তত একবার ফাস্টিং ও পিপি টেস্ট করিয়ে নিতে হবে। প্রয়োজন হতে পারে এইচবিএ১সি টেস্টেরও। প্রতি মাসে ব্লাড প্রেশারও পরীক্ষা করাতে হবে। এসব অসুখ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর গুরুতর ক্ষতি করে। তাই আগেই সচেতন হতে হবে।
ক্যানসারের বিভিন্ন পরীক্ষা
নারীদের বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার হয়ে থাকে। যেমন- জরায়ু ক্যানসার, স্তন ক্যানসার, ব্লাড ক্যানসার, ওভারিয়ান ক্যানসার ইত্যাদি। তবে নারীদের মধ্যে যেসব ক্যানসারের ঝুঁকি দিনে দিনে বাড়ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো সার্ভিক্যাল ক্যানসার। এ ক্যানসার রোধেই করা হয় প্যাপ স্মিয়ার পরীক্ষাটি। বয়স ৪০ পেরোলে প্যাপ স্মিয়ার পরীক্ষা আবশ্যক। কারণ এই পরীক্ষা সার্ভিক্যাল ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। ৩০ বছরের পর থেকেই এই পরীক্ষা শুরু করতে পারেন কিন্তু ৪০ পেরোলে তা আরও আবশ্যক হয়ে ওঠে। এ ছাড়া মেনোপজের পরে অনেক নারীর মধ্যে ওভারিয়ান ক্যানসার দেখা যায়। তাই ওভারিয়ান ক্যানসারের ঝুঁকি এড়াতে মেনোপজের আগেই নারীদের পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিয়মিত ব্রেস্ট ক্যানসার স্ক্রিনিং করতে হবে। বিশ্বজুড়েই সাম্প্রতিক সময়ে চল্লিশোর্ধ্ব নারীদের মধ্যে স্তন ক্যানসারে আক্রান্তদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্তন ক্যানসার প্রতিরোধ করার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ম্যামোগ্রাম পরীক্ষা।
হৃদরোগ
যেকোনো সময়েই নারীরা হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে চল্লিশ পেরোলে নিয়মিত হৃদযন্ত্রের পরীক্ষা ও হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। নিয়মিত চেকআপে করলে হার্ট স্ট্রোক থেকে আকস্মিক মৃত্যু প্রতিরোধ করা যায়। এ ছাড়া হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখে এমন খাবার খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি এড়ানো যায়।
রক্তচাপ
নারীদের মেনোপজ হওয়ার পরে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা বেশি মাত্রায় দেখা যায়। তাই মেনোপজের আগেই তা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। বয়স ৪০ হলে বা তার কিছু আগে থেকেই নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তচাপের দিকে খেয়াল রাখা আবশ্যক।
চোখের পরীক্ষা
চোখ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে শুরু করে। দৃষ্টি ঝাপসা এবং চোখ শুষ্ক হতে শুরু করে। এ ছাড়া ছানি বা গ্লুকোমাও দেখা দিতে পারে। তাই বয়স ৩০ হলেই বছরে অন্তত একবার চোখের পরীক্ষা করাতে হবে। ডায়াবেটিস থাকলে চোখের সমস্যার ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। করাতে হবে গ্লুকোমার টেস্ট। পাশাপাশি সিবিসি, লিভার ফাংশন টেস্টও জরুরি। তবে সবার আগে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ অবশ্যই নিতে হবে।
কিডনি
কিডনিসংক্রান্ত রোগগুলো খুব নীরবে কাজ করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ প্রথমে বুঝতে পারে না। যখন অনেকটা ক্ষতি হয়ে যায়, তখন বুঝতে পারে। কিন্তু তখন রিকভার করা খুব কঠিন হয়ে ওঠে। ব্যস্ত থাকার দরুন এবং বাইরে পর্যাপ্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন টয়লেট না থাকার কারণে নারীরা পর্যাপ্ত পানি পান করেন না। যার ফলাফল খুব খারাপ হয়। তাই বেশি করে পানি পান করা যেমন জরুরি, তেমনি নিয়মিত টেস্টের মাধ্যমে কিডনিরও খেয়াল রাখা উচিত।
নারীর শরীরের দিকে পরিবারের সবার যত্নবান হওয়া উচিত। ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি নারীকেও সচেতন হতে হবে। নারীর সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য তার প্রতি পরিবারের সবার সামান্য যত্ন এবং সচেতনতাই যথেষ্ট।
জাহ্নবী