ভ্রমণ মানে শুধু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরতে যাওয়া নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। ভ্রমণ নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে শেখায়, প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করে, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির চমৎকার লেনদেনের সুযোগ করে দেয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীদের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তার বাধার কারণে ভ্রমণ— বিশেষ করে একাকী কোথাও ঘুরে আসা একটি অপূরণীয় স্বপ্নের মতো। ভ্রমণে নারীদের নানাবিধ ব্যাপার নিয়ে লিখেছেন রাজিয়া সুলতানা
বাংলাদেশ বৈশ্বিক পর্যটনে একটি ক্রমবর্ধমান গন্তব্য হিসেবে অবস্থান করছে, এখন সময় এসেছে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার এবং ভ্রমণকে নারীদের জন্য আরও সহজলভ্য ও নিরাপদ করে তোলার। আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে স্বতন্ত্রভাবে বেশকিছু শুধু নারীদের নিয়ে ট্যুর গ্রুপ তৈরি হয়েছে। পর্যটক ও লেখক এলিজা বিনতে এলাহীর সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশে নারীদের ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা, বাধা এবং করণীয় সম্পর্কে। তার মতে, ‘ভ্রমণ শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের দেশে পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে ভ্রমণের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলা হয় না। ভ্রমণ একটি শিল্প। ভ্রমণ যেমন ব্যক্তির জন্য দরকারি, তেমনি এটি রাষ্ট্রীয় পর্যটনশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয়। বিশ্বব্যাপী পর্যটন নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, পর্যটনের মাধ্যমে তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে, পর্যটন অর্থনীতির চাকা সচল করার মাধ্যমে একটি গোটা রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প অনেক অবহেলিত। নারীর স্বাবলম্বী হওয়া, উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা, স্বাধীনভাবে চিন্তা করা, নিজেকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে ভ্রমণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভ্রমণ দেশের বাইরে হতে হবে এমন নয়, নিজের জেলা, নিজের দেশ, নিজের সংস্কৃতি জানার জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ।’
এলিজা বিনতে এলাহী ঘুরেছেন বাংলাদেশের ৬৪ জেলার আনাচে-কানাচে। তিনি মনে করেন, ‘দেশকে পর্যটনবান্ধব রাখা ও নারীবান্ধব করে তোলার জন্য নাগরিকদের দায়িত্ব রয়েছে। গণপরিবহনগুলো নারীবান্ধব নয়। আবাসনের সমস্যাও প্রকট।’ তিনি আরও জানান, ‘ভ্রমণের সঙ্গে পোশাকের একটা সম্পর্ক রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভ্রমণবান্ধব পোশাকের ক্ষেত্রে নারীদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় সব পর্যায়ে সচেতনতা প্রয়োজন। মানুষের মধ্যে চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন দরকার।’
নারীদের ভ্রমণে সাধারণত যেসব বাধা আসে তার মধ্যে রয়েছে-
সাংস্কৃতিক নিয়ম এবং সামাজিক প্রত্যাশা
বাংলাদেশের কিছু নিয়মিত পর্যটন এলাকা যেমন- কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলার ফোকাসড কিছু লোকেশন, সিলেট ইত্যাদি ছাড়া বেশির ভাগ এলাকায় ভ্রমণে নারীদের জন্য রয়েছে নানাবিধ প্রতিকূলতা। কিছু কিছু স্থানে নারীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে অলিখিত বাধা। একজন নারী একা কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে দর্শনীয় স্থান ভ্রমণের বিষয়টি সন্দেহ, সংশয় বা সম্পূর্ণ অস্বীকৃতির সঙ্গে দেখা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে সমাজ প্রত্যাশা করে যে, নারীরা তাদের পরিবারের কাছে থাকবেন, ব্যক্তিগত স্বপ্নপূরণ, অচেনা-অজানার অন্বেষণ অথবা কেবল অবসরের জন্য একাকী বাইরে বের হওয়ার পরিবর্তে ঘরোয়া দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দেবেন।
নিরাপত্তার উদ্বেগ
নারী পর্যটক জিনাত হাকিম নিরাপত্তাটাকেই সবার ওপরে রাখতে চান। তিনি বলেন, ‘দেশের বাইরে কোথাও যেতে ভ্রমণে একদমই ভাবতে হয় না। কিন্তু দেশের ভেতরে ভ্রমণে নিরাপত্তার কথাই সবার আগে ভাবতে হয়। আমাদের সমাজ মনে করে, একটি মেয়ে একা কেন ভ্রমণে যাবে- এই চিন্তাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধটা সমাজের আগে শুরু হয় পরিবারের সঙ্গে।’ বাংলাদেশে নারীদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাধা। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে হয়রানির গল্প, নিরাপদ আবাসস্থলের স্বল্পতা, রাত্রিকালীন ভ্রমণ সংশয়, পাবলিক স্পেসে অনিরাপত্তা- ভ্রমণ পরিকল্পনায় নারীর জন্য এসবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। পরিবার থেকে নারী যে বাধা পায়, তা মূলত নিরাপত্তার উদ্বেগের কারণে তৈরি হয়।
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা
নারীর জন্য ভ্রমণকে সাধারণত একটি বিলাসিতা হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বিবেচনায় আর্থিক লেনদেন আছে, এমন সিদ্ধান্তের জন্য তাদের পরিবার বা স্বামীর ওপর নির্ভর করতে হয়। এমনকি যেসব নারীর আর্থিক সংগতি বা সম্পদ রয়েছে, তারাও ভ্রমণের মতো ব্যক্তিগত ইচ্ছার চেয়ে পারিবারিক চাহিদাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়।
অবকাঠামোর অভাব
নারী পর্যটক আরিফা রহমানের কাছে নারীবান্ধব টয়লেটের অভাব এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের অপ্রাপ্যতাকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে হয়। বাংলাদেশের পর্যটন অবকাঠামো এখনো উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে, বিশেষত নারীবান্ধব অবকাঠামোয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দূরদৃষ্টি, পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের ঘাটতি রয়েছে। নারীবান্ধব পরিষ্কার বিশ্রামাগার, নিরাপদ বাসস্থান, টয়লেট এবং নিরাপদ পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মতো সুবিধার অভাব অনুভব করেন ভ্রমণপিপাসী নারী পর্যটকরা। অবকাঠামোর অপ্রতুলতা নারীদের ভ্রমণকে কঠিন করে তোলে- বিশেষ করে যারা একা ভ্রমণ করতে চান। ভ্রমণের সময় আরাম এবং নিরাপদ বোধ করা অনেক জরুরি।
পারিবারিক এবং সামাজিক চাপ
বাংলাদেশের অনেক নারীর জন্য পুরুষের সাহচর্য ছাড়া ভ্রমণকে অনুপযুক্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। ‘মানুষ কী বলবে’ তার ভয় একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা, বিশেষ করে রক্ষণশীল এলাকাগুলোয়। এমনকি বিবাহিত নারীরাও ভ্রমণের মতো বিষয় নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন। পারিবারিক দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়ার একটি সামাজিক চাপ সবসময়ই থাকে।
নারীদের ভ্রমণে উৎসাহী হওয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ?
নারীর ক্ষমতায়ন এবং আস্থা তৈরিতে
ভ্রমণ নারীদের চিরাচরিত কমফোর্ট জোনের বাইরে পা রাখার, নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার এবং ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়। হোক সেটি একটি ভিনদেশি শহর, একটি নতুন ভাষা শেখা বা নিজের দেশের প্রকৃতিতে কেবল শান্তি খুঁজে পাওয়া, এই অভিজ্ঞতাগুলো ব্যক্তিগত বৃদ্ধি এবং ক্ষমতায়নে অবদান রাখে। অনেক নারীর জন্য, ভ্রমণ হলো তাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার এবং সামাজিক প্রত্যাশা থেকে মুক্ত হওয়ার একটি মাধ্যম।
সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং নতুন দিগন্ত উন্মোচন
ভ্রমণ নারীদের বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধারণা এবং জীবনধারার সঙ্গে পরিচিত করে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে। ভ্রমণ আপনাকে আরও উন্মুক্ত মানসিকতা, সহনশীলতা এবং বোঝাপড়ার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটি এমন একটি গুণ, যা ক্রমবর্ধমান বিশ্বে আপনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। তিন পার্বত্য জেলার উপজাতীয় সম্প্রদায় থেকে কক্সবাজারের উপকূলীয় জীবন, হাওর কিংবা চা-বাগান, পাহাড় কিংবা সমুদ্র- আপনার ব্যক্তিগত জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করবে।
মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিতে
ভ্রমণ প্রাত্যহিক জীবনের ছকে বাঁধা রুটিন থেকে একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিরতি দেয়। প্রতিদিনের কাজ, পরিবার এবং সামাজিক প্রত্যাশার চাপ থেকে অব্যাহতি দেয়, যা নারীকে মানসিকভাবে পুনরুজ্জীবিত করে। আরও আত্মবিশ্বাসী এবং উন্নত মানসিকতার করে তোলে এবং মনের পাশাপাশি শরীরও ভালো অনুভব করে।
অর্থনীতিতে অবদান
যত বেশি নারী পর্যটক ভ্রমণে যুক্ত হবেন, তত বেশি তারা স্থানীয় অর্থনীতিতে সরাসরি অবদান রাখতে পারবেন। ছোট ব্যবসা, হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং পর্যটনশিল্প আরও সমৃদ্ধি অর্জন করবে। নারীদের ভ্রমণে উৎসাহিত করা স্থানীয় অর্থনীতিতে বিশেষ করে বাংলাদেশের অনুন্নত অঞ্চলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের পর্যটন খাত হওয়া চাই নারীবান্ধব
পর্যটনকে নারীদের জন্য একটি কার্যকর ও আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে নারী ভ্রমণকারীদের জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং নিরাপদ করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতকে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
উন্নত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি
সরকারের উচিত সব পর্যটক বিশেষ করে নারীদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। পর্যটন এলাকায় সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা কর্মী নিয়োজিত রাখা, যেকোনো হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, আবাসিক হোটেলগুলোয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, টয়লেট এবং খাবারের ব্যাপারে স্বাস্থ্যসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া ইত্যাদি জরুরি।
নারী পর্যটক জিনাত হাকিম মনে করেন, ‘নারীবান্ধব পর্যটনশিল্প নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পরিকল্পনা, উদ্যোগ গ্রহণ এবং কাজ করার অনেক জায়গা রয়েছে।’ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। এত বাধা কিংবা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও, নারীর ভালো থাকায় ভ্রমণও যুক্ত হোক। সব বাধা পেরিয়ে নারীর জন্য ভ্রমণ হোক নিরাপদ ও আনন্দের। উন্মুক্ত হোক প্রকৃতি ও সংস্কৃতির বদ্ধ দুয়ার।
জাহ্নবী