ঢাকা ৩০ ভাদ্র ১৪৩১, শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

যার ঝুলিতে সমুদ্রের গল্প

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৪ পিএম
যার ঝুলিতে সমুদ্রের গল্প

সিগ্রাস এমন একটি প্রজেক্ট যেখানে কার্বন ধরে রাখা হয়। এই প্রজেক্ট সমুদ্রের মাছের নার্সারি হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু সিগ্রাসের অনেক বাসস্থান এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। সিগ্রাস পুনরুদ্ধারে যুক্তরাজ্যের প্রথম প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন লিয়ানি কুলেন আনসওয়ার্থ। তিনি একজন ব্রিটিশ সমুদ্রবিজ্ঞানী। লিয়ানি কুলেন আনসওয়ার্থ প্রজেক্ট সিগ্রাসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং এই প্রজেক্টের বর্তমান সিইও।

সিগ্রাস প্রকল্প বীজ রোপণ প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য তিনি একটি রিমোট কন্ট্রোলড রোবট ব্যবহার করেন। পাশাপাশি এই প্রকল্প অন্যান্য দেশকে তাদের পানির নিচের তৃণভূমি পুনরুদ্ধারে সাহায্য করার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করে।

কুলেন আনসওয়ার্থ ১৯৭৯ সালে যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিজ্ঞানের নানা শাখায় কাজ করেছেন। সামুদ্রিক গবেষণায় ২০ বছরেরও বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। তিনি মূলত বিজ্ঞানভিত্তিক সংরক্ষণ এবং পুনরুদ্ধারের কাজ করে আসছেন। তিনি প্রধানত সাগরে ঘাসের তৃণভূমি সংরক্ষণের  কাজের জন্য পরিচিত।

কুলেন আনসওয়ার্থ ইন্দোনেশিয়ায় ম্যানগ্রোভ ও প্রবালের ওপর ফোকাস করে গবেষণা করছিলেন। সে সময় তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে সামুদ্রিক ঘাসগুলো স্থানীয় পরিবারের জন্য প্রোটিনের প্রধান সরবরাহকারী জীবনকে সমর্থন করে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৮ সালে আনসওয়ার্থ বিজ্ঞানের একটি গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক ছিলেন; যেখানে সমুদ্রঘাস রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। তিনি আরও বলেছেন যে, যুক্তরাজ্যে সমুদ্রের ঘাসগুলোকে কখনো কখনো সৈকত থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় যেন তা কিছুটা বেশি মনোরম দেখায়; যদিও তারা বাস্তুতন্ত্রের একটি মূল্যবান অংশ। কুলেন আনসওয়ার্থের গবেষণায় দেখা যায়, সাগরের ঘাসগুলো খালি হাতে মৌলিক গিয়ারসহ মাছ ধরার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণাটি একটি উন্মুক্ত লাইসেন্সের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল, যা এটিকে শুধু অ্যাট্রিবিউশনের জন্য অনুমতি ছাড়াই পুনরায় ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। এই গবেষণায় আরও দেখা যায়, অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের জন্য কুড়াল মাছ ধরা সমুদ্রঘাসের তৃণভূমিতে সাধারণ। যা সাধারণত কয়েক মিলিয়ন মানুষের খাদ্য সরবরাহে অবদান রাখে। ২০১৮ সালে আনসওয়ার্থ পরিবেশগত ক্ষতির প্রভাব সম্পর্কে একটি পত্রিকায় লিখে সবাইকে সতর্ক করেছিলেন।

সমুদ্রবিজ্ঞানী লিয়ানি কুলেন আনসওয়ার্থ তার প্রথম ডিগ্রি নেন সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানের ওপরে নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরবর্তী সময়ে তিনি ব্যাঙ্গর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সম্পর্কিত স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য অধ্যয়ন করেন। ২০০৭ সালে কুলেন আনসওয়ার্থ এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ডক্টরেট সম্পন্ন করেন। এরপর কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিএসআইআরও)-এর অর্থায়নে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণার জন্য অস্ট্রেলিয়া যান।

কুলেন আনসওয়ার্থ এক গণমাধ্যমে বলেন, ‘কারও জন্য একা কিছু অর্জন করা অনেক কঠিন। তবে নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ একসঙ্গে কাজ করছেন এবং নিজেদের মধ্যে জ্ঞান ভাগ করে নিচ্ছেন। আমি নিজে একটা ছোট কাজ করছি যাতে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক আবাসস্থলকে পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করতে পারি, যা আমাদের সমাজ ও পৃথিবীর উপকারে আসবে।’

প্রজেক্ট সিগ্রাসের সিইও থাকাকালীন ২০২৩ সালে তিনি বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর একজন হিসেবে চিহ্নিত হন আনসওয়ার্থ। নতুন সিগ্রাসে জন্মাতে পারে এমন বীজ রোপণের জন্য পানির নিচে রোবটের ব্যবহারে তার মূল ভূমিকা তুলে ধরে বিবিসি।

জাহ্নবী

নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙেন লাখপা শেরপা

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:০০ এএম
নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙেন লাখপা শেরপা

এভারেস্ট জয় করার স্বপ্ন হয়তো অনেকেরই থাকে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। কেউ আবার এভারেস্টের পথে যাত্রা শুরু করলেও প্রতিকূলতার সঙ্গে টিকে থাকতে না পেরে তার স্বপ্ন আর জীবন উভয়ই থেমে যায়। সেখানে ৫০ বছর বয়সী এক নারী বারবার এভারেস্ট চূড়ায় আরোহণ করে বিশ্বরেকর্ড তৈরি করেছেন।

বলছিলাম নেপালের নাগরিক লাখপা শেরপার কথা। মোট ১০ বার মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন তিনি এবং তিনিই হলেন প্রথম নারী পর্বতারোহী যিনি এই রেকর্ড গড়ার গৌরব অর্জন করেছেন।

নেপালের সাংখুওয়াসাভার জেলায় ১৯৭৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন লাখপা। তারা মোট  ১১ ভাই-বোন। তার যেখানে জন্ম, সেটা হচ্ছে বিশ্বের পঞ্চম উচ্চতম পাহাড় মাকালুর একটি অংশ। তাই শৈশব থেকেই পাহাড়ের সঙ্গে ছিল নিত্যদিনের জীবনযাপন। এভারেস্ট জয় করা যখন সবার জন্য প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার, লাখপা শেরপার জন্য তা তুলনামূলক সাবলীল ব্যাপার।

পরিবার চালানোর জন্য তার বাবার বড় কোনো আয়ের পথ ছিল না। ছোট্ট একটি চায়ের দোকান থেকে যা উপার্জিত হতো, তা দিয়ে চলত সংসার। তাই মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকে তিনি এভারেস্ট আরোহীদের মালপত্র বহনের কাজ শুরু করেন। তবে কখনো চূড়া পর্যন্ত ওঠেননি। এভাবে ১২ বছর কাজ করার পর ২০০০ সালের ১৮ মে তিনি প্রথমবারের মতো এভারেস্ট জয় করেন এবং তখন পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রথম নেপালি নারী যিনি এভারেস্ট চূড়া থেকে জীবিত অবস্থায় ফিরতে পেরেছিলেন।

তিনি যেন বারবার নিজেই নিজের রেকর্ড ভেঙেছেন। ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি তিনবার এভারেস্ট চূড়ায় আরোহণ করেন এবং তখনো বিশ্বে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বেশি সংখ্যকবার এভারেস্টজয়ী নারী। সেই বছর তিনি শুধু একাই আরোহণ করেননি, সঙ্গে তার বোন ও ভাইও ছিল। ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছয়বার এভারেস্ট জয় করেন।

উত্তর-পূর্ব নেপালের মারকালুতে জন্ম নেওয়া লাখপা এখন বাস করেন আমেরিকার কানেকটিকাটের ওয়েস্ট হার্টফোর্ডে। বিয়ের পর তিনি স্বামীর সঙ্গে আমেরিকা চলে যান। যদিও কয়েক বছর পর তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। দুই সন্তান নিয়ে তিনি আলাদা হয়ে যান। গিনেস বুকে নাম তোলা এই নারী এখন বেঁচে থাকার জন্য থালাবাসন ধোয়ার কাজ করে অর্থ আয় করছেন। যত দিন শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান আছেন, তত দিন তিনি এভারেস্টে আরোহণ করতে চান। গিনেস রেকর্ড করার পরও এভারেস্টে আরোহণ করার জন্য তিনি স্পন্সর পান না বললেই চলে। কিন্তু এভারেস্টপ্রেমী লাখপা জীবনের এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করে নিজের পরিবার চালান এবং এভারেস্টে আরোহণ করার অর্থ সঞ্চয় করেন।

জাহ্নবী

সফলতম দুই নারী অলিম্পিয়ান

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:১৫ পিএম
আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:১৫ পিএম
সফলতম দুই নারী অলিম্পিয়ান
কেটি লেডেকি ও সিমোন বাইলস

এবারের প্যারিস অলিম্পিক যেন সাজিয়েছিল কোনো গল্পের আসর। অলিম্পিক শেষ হলেও শেষ হচ্ছে না এই অলিম্পিক ঘিরে মানুষের আলোচনা-সমালোচনা। যুক্তরাষ্ট্রের দুই নারী কেটি লেডেকি ও সিমোন বাইলসও রয়েছেন সেই আলোচনায়।

সাঁতারু জলকন্যা ক্যাটি লেডেকি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অলিম্পিকে সর্বোচ্চ পদকজয়ী নারী অ্যাথলেট। ২৭ বছর বয়সী এই নারী অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন মিলিয়ে মোট ৩৯টি পদক জিতেছেন। অলিম্পিক জিতেছেন ১৪টি, যার মধ্যে স্বর্ণ পদক রয়েছে ৯টি। লেডেকির জন্ম ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে। লেডেকির সাঁতারে আসা তার ভাইয়ের হাত ধরে। তার বড় ভাই মাইকেল লেডেকি তাকে গ্রীষ্মকালীন সাঁতারের প্রোগ্রামে যোগ দিতে বলেছিলেন। তখন ছোট লেডেকির বয়স মাত্র ছয় বছর। সেই বয়সেই তিনি সাঁতার কাটা শুরু করেন। এবারের প্যারিস অলিম্পিকে মেয়েদের ১৫০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে স্বর্ণপদক জিতেছেন আমেরিকান এই জলকন্যা।

তিনি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সর্বোচ্চ স্কোরকারী নারী সাঁতারু হিসেবে ফিনা ট্রফি জিতেছেন। ক্যাটি লেডেকি ২০২১ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে মেজর এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাইনর বিষয় হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

প্যারিস অলিম্পিকের আরেক সফলতম নারী জিমন্যাস্ট সিমোন বাইলস। মজার বিষয় হচ্ছে, ক্যাটি লেডেকির মতো সিমোন বাইলসেরও বয়স ২৭ বছর এবং তবে তিনি মোট পদক জিতেছেন ৪১টি। তিনিও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। সিমোন বাইলসের জন্ম ১৯৯৭ সালের ১৪ মার্চ। তার পুরো নাম সিমোন আরিয়ান বাইলস ওয়েন্স। সিমোন বাইলস এবারের প্যারিস অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে জিমন্যাস্টিকসে তিনটি স্বর্ণপদক এবং  একটি রৌপ্য পদক জিতেছেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে একটি জিমন্যাস্টিকসে ডে-কেয়ার ফিল্ড ট্রিপের সময় সিমোন জিমন্যাস্টিকসে আগ্রহী হয়ে উঠেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তার কোচ এমি বুরম্যানের নির্দেশনায় ১১ বছর সেই জিমন্যাস্টিকসের ডে-কেয়ার ফিল্ডে ছিলেন। সিমোন ২০১০ সালে নারী জুনিয়র অলিম্পিক ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে ফ্লোর এক্সারসাইজে স্বর্ণ এবং ভল্টে একটি ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন। এর এক বছর পর ২০১১ সালে প্রতিযোগিতার অভিজাত স্তরে প্রবেশ করেন সিমোন বাইলস। পরবর্তী সময়ে মাত্র দুই বছরের কম সময়ের ব্যবধানে তিনি জিমন্যাস্টিকসে আধিপত্য বিস্তার করেন। ২০১৬ সালের পরবর্তী সময়ে সিমোন জিমন্যাস্টিকস থেকে বিরতি নেন। ২০১৮ সালে আবার প্রতিযোগিতায় ফিরে এসে তিনি ইউএস জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে প্রায় ২৫ বছরের মধ্যে প্রথম নারী জিমন্যাস্ট হয়েছিলেন। সিমোন এখন পর্যন্ত তার অলিম্পিক ক্যারিয়ারে সাতটি স্বর্ণ, দুটি ব্রোঞ্জ এবং একটি রৌপ্যপদক জিতেছেন।

জাহ্নবী

নারী ভোটাধিকার প্রদানে প্রথম দেশ নিউজিল্যান্ড

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:১৩ পিএম
আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:১৩ পিএম
নারী ভোটাধিকার প্রদানে প্রথম দেশ নিউজিল্যান্ড

উনিশ শতকের শেষ দিকের ঘটনা। ইউরোপের নারীরা চাইলেন, তারাও পুরুষদের পাশাপাশি দেশের প্রতিনিধি নির্বাচনে অংশ নেবেন। কিন্তু সেই অধিকার তাদের ছিল না। ইউরোপ মহাদেশেও নারীরা ভোট দিতে পারতেন না এটা খুব অবাক করা ব্যাপার। ভোট দেওয়ার অধিকার আদায় করতে নারীরা তাদের জীবন পর্যন্ত দিয়েছিলেন। অবশেষে ১৮৯৩ সালে নিজেদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে নিউজিল্যান্ডের নারীরা ভোট দেওয়ার অধিকার পান। সেটাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে নারীদের ভোটের অধিকার পাওয়ার প্রথম ঘটনা। এরপর ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, সুইডেন, কিছু অস্ট্রেলীয় উপনিবেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঙ্গরাজ্যের নারীরা সীমিত আকারে ভোটের অধিকার আদায় করে নেন। 

এর কিছু পরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংগঠন গঠনের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টার সমন্বয় সাধন করা হয়। এদের মধ্যে ১৯০৪ সালে জার্মানির বার্লিনে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নারী ভোটাধিকার মৈত্রী উল্লেখযোগ্য, যারা নাগরিক হিসেবে নারীর সমান অধিকারের জন্যও কাজ করতেন। বাকি দেশগুলোয় নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে বেশ কয়েক বছর আন্দোলন চলমান থাকে। ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ নারীরা ভোট দেওয়ার অধিকার পান। তারপর ১৯২০ সালে মার্কিন নারীরা ভোটাধিকার পান। বর্তমানে বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া প্রায় সব দেশের নারীরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন এবং নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবেও অংশগ্রহণ করতে পারেন। মধ্যপ্রাচ্যে নারীরা তাদের ভোটাধিকার অর্জনের জন্য সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আন্দোলন চালিয়েছেন। কিছু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যেমন- আফগানিস্তান, পাকিস্তান, লেবানন, সিরিয়া, ইরান, ইরাক ও ইয়েমেন ১৯৫০ থেকে ১৯৭০-এর দশকের মধ্যে নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত নারীদের ভোটাধিকার হরণ করে। অন্যদিকে, ওমানে ১৯৯৭ সালে, কাতারে ১৯৯৯ সালে, বাহরাইনে ২০০২ সালে নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। সর্বশেষে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এসে সৌদি আরবের নারীরা প্রথমবারের মতো দেশটির পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাতিসংঘ নারীদের ভোটাধিকারকে উৎসাহিত করতে থাকে এবং ১৯৮১ সালে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ নামক সনদে জাতিসংঘের ১৮৯টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে নারীর ভোটাধিকারকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে গোটা সমাজ তথা দেশে নারীদের জন্য একটি নতুন দ্বার উন্মোচন হয়।

জাহ্নবী

নারীর সমৃদ্ধিতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:০৩ পিএম
নারীর সমৃদ্ধিতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা
মডেল: সুমাইয়া লিলি, ছবি: শরিফ মাহমুদ

চলমান এই দ্রুতগতির বিশ্বে আজকের নারীর জন্য সুযোগগুলো যেমন বিস্তৃত, তেমনি সেই সুযোগের সঙ্গে যথাযথভাবে নিজেকে মেলে ধরার চ্যালেঞ্জও অনেক। যদিও সামাজিক প্রত্যাশা হলো নারীকে ঐতিহ্যগত ভূমিকায় দেখতে পাওয়া, কিন্তু নিজেকে বিভিন্ন দক্ষতায় সমৃদ্ধ করতে পারাই নারীকে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষমতায়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। দক্ষতা নারীর আত্মবিশ্বাস তৈরি করে এবং সামাজিক অবদানের দিকে নারীকে পরিচালিত করে। নতুন কোনো দক্ষতা অর্জন, সেটা হতে পারে প্রযুক্তিগত কিংবা ব্যবহারিক, তা আপনার জন্য নিজেকে পরিবর্তনের চাবিকাঠি হতে পারে। কিছু কিছু দক্ষতা নিজেকে সীমিত সম্ভাবনার জীবনবোধ থেকে সীমাহীন সম্ভাবনার দৃষ্টিতে দেখার অনুভূতি দিতে পারে। তেমনই কিছু উল্লেখযোগ্য আচরণিক এবং কারিগরি দক্ষতা নিয়ে লিখেছেন রাজিয়া সুলতানা

স্কুটি বা গাড়ি ড্রাইভিং দক্ষতা 
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্কুটি বা গাড়ি চালানো হতে পারে আপনার জন্য একটি লাইফ সেভিং জাদুকরী দক্ষতা। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের হয়রানির সঙ্গে বাইরে বের হওয়া কমবেশি সব নারীই পরিচিত। স্কুটি বা গাড়ি ড্রাইভিং দক্ষতা আপনার জন্য যেমন পথ চলার নিরাপত্তা নিয়ে আসতে পারে, তেমনি এটি সময় বাঁচাতে, অন্যের ওপর আপনার নির্ভরতা কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটি আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে অনেক গুণ। ভেবে দেখুন আপনি যখন পাবলিক বাসে ভিড়ে পিষ্ট হয়ে ঘামছেন, তখন সিগন্যালে সাঁই করে স্কুটি নিয়ে বের হয়ে যাওয়া একজন নারীর চলে যাওয়া দেখতে কতটা ভালো লাগা কাজ করে। আপনি নিজেও এই দক্ষতাটি আয়ত্ত করতে পারেন। এজন্য শুধু দরকার আপনার ইচ্ছাশক্তি। 

ডিজিটাল লিটারেসি এবং অনলাইন দক্ষতা
ডিজিটাল এই যুগে ইন্টারনেট কীভাবে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হয় তা জানা পড়ালেখার মতোই অপরিহার্য। অনলাইন গবেষণা পরিচালনা থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া পরিচালনা পর্যন্ত ডিজিটাল সাক্ষরতা একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা যা শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং উদ্যোক্তার দরজা খুলে দেয়।

গ্রাফিক্স ডিজাইন
গ্রাফিক্স ডিজাইন একটি সৃজনশীল দক্ষতা যা মার্কেটিং, বিজ্ঞাপন এবং ফ্রিল্যান্স কাজের ক্ষেত্রে ক্যারিয়ারের সুযোগ তৈরি করতে পারে। এই দক্ষতাটি আপনার পেশাদার পোর্টফোলিওতে বাড়তি মাত্রা যোগ করবে। 

ফটোগ্রাফি এবং ভিডিওগ্রাফি
ফটোগ্রাফি এবং ভিডিওগ্রাফি এমন একটি দক্ষতা যা মিডিয়া, সাংবাদিকতা এবং ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরিতে ক্যারিয়ার গড়তে পারে। এই দক্ষতা আপনাকে আরও সৃজনশীল করে তুলবে এবং আপনি আপনার গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো ধরে রাখতে পারবেন।

যোগাযোগ দক্ষতা
ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উভয় জীবনেই কার্যকর যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যোগাযোগের প্রশিক্ষণ নারীদের নিজেকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে, গঠনমূলক মতামত প্রকাশ করতে এবং শক্তিশালী আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। যোগাযোগের দক্ষতা আপনাকে সবার কাছে আরও গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় কোর্স করার সুযোগ রয়েছে। সেসব কোর্সের মাধ্যমে আপনি নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারেন।

সময় ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদনশীলতা
ব্যক্তিগত এবং পেশাগত দায়িত্বের ভারসাম্যের জন্য কীভাবে দক্ষতার সঙ্গে সময় পরিচালনা করতে হয়, তা জানা অনেক জরুরি। সঠিকভাবে সময়কে ব্যবহার করতে পারার দক্ষতা আপনাকে সবার থেকে এগিয়ে রাখবে।

পাশাপাশি ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের চাপও কমবে। বেশকিছু প্রতিষ্ঠান অনলাইনে উৎপাদনশীলতা এবং সময় ব্যবস্থাপনা দক্ষতার উন্নতির জন্য বিশেষ কোর্স এবং সেমিনারের আয়োজন করে থাকে। 

আলোচনার দক্ষতা
বেতন, চুক্তি কিংবা পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা হোক না কেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে নারীর যা প্রাপ্য তা নিশ্চিত করার জন্য আলোচনার দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দক্ষতা আপনাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। নিজেকে বঞ্চিত হওয়ার অনুভূতি থেকে সুরক্ষিত রাখবে। 

ব্যক্তিগত অর্থ ব্যবস্থাপনা
অর্থ ব্যবস্থাপনার জ্ঞান ও দক্ষতা ব্যক্তিগত এবং পরিবারের বাজেট পরিচালনা, সঞ্চয়, বিনিয়োগে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক লক্ষ্য অর্জনের চাবিকাঠি। এই দক্ষতা আপনাকে অপচয় থেকে দূরে রাখবে এবং পরিবারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় আপনাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। 

বিদেশি ভাষার দক্ষতা
একটি বিদেশি ভাষা জানা আন্তর্জাতিক চাকরির সুযোগের দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে, ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বাড়াতে পারে এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আপনি সুবিধা পেতে পারেন। নিজের পছন্দ অথবা প্রয়োজনের সঙ্গে মিল রেখে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে বিদেশি ভাষা শিখতে পারবেন।

বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ
বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নারীর ক্ষমতায়নের আরেকটি শক্তিশালী হাতিয়ার। টেইলারিং, সৌন্দর্য পরিচর্যা বা হস্তশিল্প যাই হোক না কেন, বৃত্তিমূলক দক্ষতা নারীদের ছোট ব্যবসা তৈরি করতে বা তাদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা উন্নত করতে সহায়তা করে।

প্রাথমিক চিকিৎসা এবং ইমার্জেন্সি রেসপন্স 
প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ নারীদের বাড়িতে বা জরুরি প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে অপরিহার্য করে তুলতে পারে। এই দক্ষতা একজন সচেতন নারীর জন্য বিশেষভাবে মূল্যবান। বর্তমান বন্যা পরিস্থিতিতে যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অবদান রেখেছেন তারা এর প্রয়োজনীয়তা ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারছেন। এই দক্ষতা যেকোনো দুর্যোগে আপনাকে মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় করে তুলতে পারে।

দক্ষতা অর্জনের যাত্রা একটি কোর্স বা প্রশিক্ষণ সেশন দিয়ে শেষ হয় না। আজকের পরিবর্তিত বিশ্বে প্রাসঙ্গিক থাকার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষা অপরিহার্য। টেকসই ক্ষমতায়নের জন্য নারীদের ক্রমাগত নতুন দক্ষতা ও জ্ঞান অন্বেষণে উৎসাহিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নারীর দক্ষতা অর্জনে আর্থিক সীমাবদ্ধতা, প্রশিক্ষণ সুবিধার সীমিত সুযোগ, সামাজিক বাধা অতিক্রম করার জন্য সবার সমর্থন এবং সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার থেকে কন্যা, স্ত্রী এবং মায়েদের শিক্ষা এবং দক্ষতাকে মূল্য দেওয়া, সমর্থন করা, উৎসাহিত করা একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নিয়ে আসতে পারে। পাশাপাশি, নারীদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের বা বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম প্রদানের জন্য আরও সরকারি এবং এনজিওর নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন শুধু একজন নারীর ব্যক্তিজীবনকে উন্নত করার জন্য নয়; এটি একটি শক্তিশালী, আরও অংশগ্রহণমূলক সমাজ গড়ার জন্য প্রয়োজনীয়।

কলি

 

‘বাংলাদেশিরা এতটা ঐক্যবদ্ধ তা এই প্রথম অনুভব করলাম’

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৩৫ পিএম
আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৪৬ পিএম
‘বাংলাদেশিরা এতটা ঐক্যবদ্ধ তা এই প্রথম অনুভব করলাম’
হোসনে আরা প্রাপ্তি, সামিয়া আক্তার ও সুমাইয়া সাইনা

দেশে যে দুর্যোগই হোক না কেন, পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও সবসময় সেসব দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এবার স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হলো বাংলাদেশ। এই আকস্মিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে সবাই যেন এক নতুন বাংলাদেশকে দেখতে পেল। নারী-পুরুষ, তরুণ-বৃদ্ধ সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একতার যে অনন্য সেতুবন্ধন তৈরি করেছে, তা মুগ্ধ করেছে সর্বস্তরের মানুষকে। বন্যার্তদের সহযোগিতায় অবিশ্রান্ত কাজ করে যাচ্ছেন, এমন কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন মোহনা জাহ্নবী

সামিয়া আক্তার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। বন্যার্তদের জন্য কাজ করার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বন্যার্তদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবার প্রথম। এর আগে আমি এ ধরনের কোনো কাজ করিনি। অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যার কারণে যখন আমার দেশ ও দেশের মানুষের জীবন বিপন্ন, তখন বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়াতে, সহযোগিতা প্রদানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘গণত্রাণ সংগ্রহ’ কর্মসূচি ঘোষণা দেয় এবং আমি সেই কর্মসূচিতে একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করি। আমরা প্রতিদিন টিএসসি বুথে বানভাসি মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসা মানুষদের থেকে নগদ অর্থ, শুকনো খাবার, প্রয়োজনীয় মেডিসিন, শিশুখাদ্য, পোশাক, স্যালাইন, স্যানিটারি ন্যাপকিন, বিশুদ্ধ পানি গ্রহণ করে থাকি। এই সংগ্রহ করা অর্থ ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন যেসব ত্রাণসামগ্রী সংগৃহীত হয়, তা সারা দিন ব্যাপক সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবকের অংশগ্রহণে প্যাকেজিং করা হয়। প্যাকেজিং শেষে সেগুলোকে ট্রাক, পিকআপ এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় এয়ার কার্গোতে করে প্রয়োজনের ভিত্তিতে বন্যাকবলিতে এলাকাগুলোয় সরবরাহ করা হয়। আমার অভিজ্ঞতা মূলত ত্রাণ সংগ্রহ নিয়ে। আর এ ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রমে অংশ নিয়ে আমি বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই, যা আমাকে সত্যিই অভিভূত করে। এই গণত্রাণ কার্যক্রমে সারা দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এ কার্যক্রমকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। একজন রিকশাচালক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, আইনজীবী, স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী, শিশু- সবার অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরাও অর্থ প্রদানের মাধ্যমে আমাদের এই ত্রাণ সংগ্রহে অংশগ্রহণ করেছেন। অনেক আপু যাদের কাছে নগদ অর্থ ছিল না, তারা তাদের স্বর্ণালংকার যেমন- চুড়ি, কানের দুল, চেইন, আংটি দিয়ে গেছেন আমাদের কাছে এসে, যা দেখে সত্যিই আমি আবেগাপ্লুত হই। একটা জাতীয় সংকটে আমরা সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবার ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণে তা মোকাবিলা করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা যে জাতি হিসেবে কতটা ঐক্যবদ্ধ, এই ঘটনা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে এসে আমাদের কাছে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিয়ে যায় বন্যার্তদের জন্য। শিগগিরই আমরা এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব।’

স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে আমি কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হইনি। আমার প্রতি অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক ভাই ও বোনদের পূর্ণ সহযোগিতা ও সম্মান ছিল এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। যেকোনো সমস্যায় পড়লে সবাই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসে তা সমাধান করার জন্য।’

এই সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে তার প্রতি পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি বা অনুভূতি সম্পর্কে সামিয়া বলেন, ‘আমার এসব কাজে পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত ইতিবাচক। তারা আমাকে নিয়ে খুবই খুশি এবং আমার এই সামাজিক কাজে তাদের পূর্ণ সমর্থন ও দোয়া রয়েছে। আমি দেশ ও দেশের মানুষের সহায়তায় কিছু করতে পারছি ভেবেই তারা আমায় নিয়ে খুবই আনন্দিত।’

হোসনে আরা প্রাপ্তি, সরকারি শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী। বন্যার্তদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবু অনেক নারী হাসিমুখে এসব কাজ করে যাচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশ যে বন্যার মুখোমুখি হয়েছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং পার্শ্ববর্তী দেশের আমাদের প্রতি অবহেলার ফল। কেউ ভেসে যাচ্ছে স্রোতে কিংবা কারও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের মানুষ কিংবা প্রবাসী তারা কেউ পরিবার আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। এমন আরও হাজারও দুঃখ ভরা সংবাদ আমরা শুনতে পাচ্ছি। এই বিষয়গুলো আমাদের ভাবাচ্ছে। সাঁতার জানা নেই তাই বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় যেতে পারিনি। তবে ত্রাণ সংগ্রহ এবং প্যাকেজিংসহ যারা বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় যাচ্ছে তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। আমরা টিএসসিতে কাজ করছি মানুষের জন্য। ছেলেমেয়ে, ছোট-বড়, এমনকি আমাদের মা-বাবার বয়সের মানুষদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করছি। নতুন করে শিখছি অনেক কিছু। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুকনো খাবার, জামাকাপড়, খাবার স্যালাইনসহ গুরুত্বপূর্ণ পণ্য প্যাকেজিং করছি। আলহামদুলিল্লাহ। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই অনুভূতি জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতির একটি হয়ে থাকবে।’

বন্যার্তদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নানাবিধ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন প্রাপ্তি। তিনি বলেন, ‘বন্যার্তদের জন্য কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি যা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, তা হলো একতা। আমরা বাংলাদেশিরা এতটা ঐক্যবদ্ধ তা এই প্রথম অনুভব করলাম। ছোট শিশু থেকে বৃদ্ধ, শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষক, রিকশাচালক কিংবা সমাজের উচ্চবিত্ত সব স্তরের মানুষ এক হয়ে গেছে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। এই যে একতা এটা আমাকে চমৎকারভাবে প্রভাবিত করেছে। আমরা টিএসসি প্রাঙ্গণে দেখেছি কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাদের জন্য বাধা হতে পারেনি। তারা সব বাধা জয় করে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে।’

কাজ করতে গিয়ে নারী হিসেবে আলাদা করে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানুষের জন্য কাজ করছি। বানভাসি মানুষগুলো অনাহারে আছে, শিশুরা আশ্রয় খুঁজছে, একটু উষ্ণতা আর খাদ্য তাদের প্রশান্তি দিতে পারে। তাদের জন্য আমরা নারী-পুরুষ সবাই এক হয়ে কাজ করছি। এই কাজে নারী-পুরুষ একসঙ্গে একে অপরকে সহযোগিতা করছি। নারী হিসেবে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়িনি। বরং কাজের ক্ষেত্রে ছাত্ররা আমাদের সহযোগিতা করছে। বেশি ভারী কাজগুলো ছেলেরা করছে। প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে যারা ত্রাণ দিচ্ছে তাদের বেশির ভাগই ছাত্র কিংবা পুরুষ। তারা নারী, শিশু, বৃদ্ধদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। নারী হিসেবে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো আমরা সহজেই করতে পারি না। আমরা ত্রাণ সংগ্রহ করছি, প্যাকেজিং করছি, সেই কাজেও আমাদের সঙ্গে ছেলেরা সহযোগিতা করছে। সর্বোপরি আমরা নারী-পুরুষ একত্রে একটা দল হয়ে আমাদের মানুষদের, শিশুদের নিরাপদ রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে চলেছি।’

সুমাইয়া সাইনা, ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী। তার কাছে জানতে চাইলাম, এই যে বন্যার্তদের নিয়ে কাজ করছেন এসব কাজে তো সবাই আগ্রহ প্রকাশ করে না, এই মানবিক বা সামাজিক কাজের প্রতি আপনার আগ্রহ তৈরি হলো কীভাবে? উত্তরে তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েকদিন ধরে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি জীবনযাপন করছে। হাজার হাজার মানুষের ঘর ভেসে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা দেখছি পর্যাপ্ত খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানির অভাব। বৃদ্ধ নারী ও শিশুরা পড়েছে চরম বিপাকে। মৃত ব্যক্তির লাশকে ভাসিয়ে দিতে হচ্ছে জলে, কারণ দাফন দেওয়ার মতো স্থান নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। এমতাবস্থায় একজন মানুষ হিসেবে ঘরে বসে থাকা আসলেই সম্ভব নয়। সেই জায়গা থেকেই বন্যার্তদের সহযোগিতা এগিয়ে আসা।’

তার কাছে আরও জানতে চাইলাম, সবাই বলছে বাংলাদেশের এই ঐক্য আগে কখনো দেখেনি। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী? তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমাদের এই ঐক্যটা গড়ে উঠেছে। কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যখন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর দমন-নিপীড়ন চালানো শুরু হয়, তখন সারা দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করেছে। এদিকে গণ-অভ্যুত্থান সফল হতে না হতেই ভারত বাঁধ খুলে দেওয়ায় আকস্মিকভাবে বন্যা শুরু হলো। এমতাবস্থায় ভারতের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। এত বড় ত্যাগ ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যে নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, তা রক্ষা করার জন্য মানুষ পুনরায় এক হয়েছে। চরম অবক্ষয় এবং ব্যক্তি স্বার্থের যুগে এমন ঐক্যবদ্ধতা প্রমাণ করে মানুষের মধ্যে মানবিকতা ও সহনশীলতা এখনো ফুরিয়ে যায়নি।’

বন্যা প্রতিরোধে আমাদের কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে আপনি মনে করেন? এ প্রশ্নের জবাবে সুমাইয়া বলেন, ‘যেহেতু প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে আমরা অনেকগুলো নদী ভাগাভাগি করছি ফলে ভারতকে আন্তর্জাতিক নদী আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। তিস্তাসহ সব নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাঁধগুলো নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক নদী আইন মানতে হবে। সব অসম চুক্তি মূল্যায়নের মাধ্যমে পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং নতজানু পররাষ্ট্রনীতি পরিহার করতে হবে। বন্যাসহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণগুলো চিহ্নিত করে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে এবং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংসের যে প্রকল্পগুলো রয়েছে সেগুলো অবিলম্বে বাতিল করে পরিবেশবান্ধব প্রকল্পগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে।’

জাহ্নবী