৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের মানুষ ঢাকার পথে পথে অনন্যসাধারণ দৃশ্য অবলোকন করেছেন। একটি বিজয় যেটি ছাত্র-জনতা একাত্ম হয়ে অর্জন করেছে, সেই বিজয়কে উজ্জ্বলভাবে ধরে রাখতে ছাত্রছাত্রী ও তরুণ সমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এল একতা এবং দায়িত্বের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। এটি এ দেশের ছাত্র-জনতার দেশপ্রেমের এক অভূতপূর্ব নিদর্শন। আক্ষরিক অর্থেই দেশ সংস্কারের এই কাজে তরুণ সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ট্রাফিক সিগন্যাল থেকে দেয়ালের গ্রাফিতি, সব জায়গায় তরুণদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন তরুণীরা। এ যেন কাজী নজরুল ইসলামের ‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ এই পঙ্ক্তির দৃশ্যায়ন। ঢাকার রাস্তায় বিভিন্ন কাজে যুক্ত তরুণীদের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজিয়া সুলতানা
দৃশ্য ১
নারমিন নাওয়ার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। তিনি ৬ আগস্ট, বিজয় অর্জনের ঠিক পরদিন জাতীয় সংসদ ভবন যান, সংসদ ভবনের লুটপাট আর বেহাল দশা তাকে এমনভাবে ব্যথিত করে যেন তার নিজের প্রিয় ঘরটিকে কেউ লুটপাট করে নিয়ে গেছে। নারমিন ওই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেন সবকিছু ঠিক করার কাজে নামবেন। প্রথম দিন তিনি তার বোনদের সঙ্গে নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ করতে থাকা নাজনীন নামের আরেক শিক্ষার্থীর একটি গ্রুপে যুক্ত হন। দিনভর ক্লান্তিহীন পরিচ্ছন্নতা আর গোছগাছ শেষে বাসায় ফিরে তার মনে হয়, আরও লোকবল প্রয়োজন। সংসদ ভবনের দুরবস্থার ছোট ছোট ভিডিও তিনি পোস্ট করেন তার স্কুল, কলেজসহ পরিচিত সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপগুলোয়। অভাবনীয় সাড়া মেলে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় করে নারমিনরা পরদিন আবার হাজির হন। মেয়েদের বড়সড় একটি দল কাজে লেগে পড়ে।
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আসবাব, চেয়ার-টেবিলকে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যেতে মেয়েরা মিলে তৈরি করেন হিউম্যান চেইন। তারা দেখছিলেন ছেলেরা একটি জিনিস একা অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছেন এবং খুব ক্লান্ত হচ্ছেন। তারা তখন হিউম্যান চেইনের মাধ্যমে আসবাবপত্র পাস করে নির্ধারিত জায়গায় বসান।
অনেক দর্শনার্থী তখনো সংসদ ভবনে আসা-যাওয়া করছিলেন। নারমিন তার নেতৃত্বগুণে তাদেরও কাজে সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করেন। এভাবে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ শেষ করার পরিকল্পনা ছিল, তা সবার সহযোগিতায় বিকেল ৪টা নাগাদ শেষ হয়ে যায়।
কেমন লেগেছে জানতে চাওয়ায় নারমিন বলেন, ‘দেশের জন্য কিছু করতে চাওয়ার ইচ্ছা সবসময়ই ছিল। কিন্তু আগে কিছু করতে চাইলে কোনো নির্দিষ্ট দল বা ব্যানারে করতে হতো, যা সবসময় স্বাচ্ছন্দ্যের ছিল না। এই কাজটি মন থেকে ভালোবেসে, কোনো প্রকার চাওয়া-পাওয়া বা ভয়ের ঊর্ধ্বে করতে পেরেছি, এটা অনেক তৃপ্তির ছিল। আমরা এত মানুষ পরিশ্রম করেছি, এত মানুষের খাওয়া-দাওয়া, কোথাও কোনো বাধা পেতে হয়নি। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছে, প্রশংসা করেছে। সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো আমরা সব মানুষের মধ্যে দেশের জন্য স্বেচ্ছাসেবার একটি মানসিকতা তৈরি করতে পেরেছি। সবার ভালোবাসা পেয়েছি।’
দৃশ্য ২
নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থী জেরিন আক্তার জাফরিন। জেরিন তার সঙ্গে ১২ জন মেয়ের একটি গ্রুপ নিয়ে পরিচ্ছন্নতার কাজ করেছেন মিরপুর-১০ ও তার আশপাশের এলাকায়। জেরিন জানান, তারা যখন মিরপুর পরিষ্কারের কাজ করছেন, তখন এক ভাই বাইকে করে এসে জানতে চান তাদের কিছু লাগবে কি না। তারা হ্যান্ড গ্লাভসের প্রয়োজনীয়তা জানালে মিনিট পনেরো পর সেই ভদ্রলোক হ্যান্ড গ্লাভস নিয়ে হাজির হন।
পরিচ্ছন্নতা শেষে আটটি ময়লাভর্তি বস্তা তারা কী করবে এই নিয়ে যখন ভাবছিলেন, তখন এগিয়ে আসেন একজন রিকশাওয়ালা। বিনা ভাড়ায় রিকশায় তুলে ময়লার বস্তা ফেলে আসেন সিটি করপোরেশনের নির্দিষ্ট স্থানে। একজন মেয়ে হিসেবে এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে অনেক আনন্দিত ও গর্বিত জেরিন।
দৃশ্য ৩
নওরিন জাহান নিহা, পড়াশোনা করছেন বিএএফ শাহিন কলেজ, ঢাকায়। আরও দুজন মেয়ে বন্ধুসহ সাজিয়ে তুলেছেন মিরপুরের মেট্রোরেলের পিলারসহ বিভিন্ন জায়গা। নিহা জানান, ‘দেয়ালের আর্টওয়ার্কগুলো আমাদের দেশকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার একটি উদ্যোগ। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের হারিয়ে যাওয়া ভাইবোনদের স্মরণ করার পাশাপাশি বাঙালি জাতির প্রতিবাদী চেহারাটা তুলে ধরতে চেয়েছি। এ ছাড়া ছিল দেশকে সুশৃঙ্খল করার জন্য সচেতনতার ডাক। আমরা চাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বর্তমান জেন-জির এ উদ্যোগ থেকে অনুপ্রেরণা ও নির্দেশনা পাক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্দ্বিধায় কথা বলুক।’
নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে নিহা আরও বলেন, ‘জীবনে অনেক আঁকাআঁকি করেছি, এমন অসাধারণ অনুভূতি আর কখনোই হয়নি। সাধারণ মানুষের এমন ভালোবাসা পাওয়া সত্যিই অন্যরকম। আমি দেশের জন্য এখন আরও বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
দৃশ্য ৪
আফনান মাহিয়াত নেহা, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষার্থী। বাড্ডা-রামপুরা এবং হাতিরঝিলের রোডে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমাদের দেশে নারীদের এই ফিল্ডে দেখা যায় না। সাধারণত আমাদের ট্রাফিক সিগন্যালগুলোয় পুরুষদের দেখা যায়, নারী হিসেবে নতুন একটি অভিজ্ঞতা। যদিও ব্যতিক্রমী কাজ, তবে নারী হিসেবে বিশেষ কোনো পার্থক্য বা চ্যালেঞ্জ আমি পাইনি। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অনেক সাপোর্ট করেছে, কথা শুনেছে, অনেক শ্রদ্ধা পেয়েছি, দোয়া পেয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ যে কত সাপোর্টিভ, তা এই কয়দিন রাস্তায় না বের হয়ে থাকলে কেউ বুঝবে না।’
জাহ্নবী