‘মম ব্রেইন’ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি নতুন এবং ন্যূনতম প্রচারিত শব্দ। ‘মম ব্রেইন’ মূলত আমাদের একজন ভুলে যাওয়া মায়ের ছবি মনে করিয়ে দেয়, যে মা কলার খোসা হাতে রেখে কলাটাই ঝুড়িতে ফেলে দেন, তরকারিতে লবণ একাধিকবার দিলেও মনে হয় লবণ দেওয়াই হয়নি, কথার মাঝখানে কারও নাম অথবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মনে করতে পারেন না। এটি এমন একটি পরিস্থিতি যা নিয়ে অনেকে রসিকতা করেন, কিন্তু যারা এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যান তাদের জন্য এই ‘মা মস্তিষ্কের’ বাস্তবতা বিস্ময়কর, একইভাবে হতাশাজনক। স্মৃতিশক্তির এই হঠাৎ পতনের পরিবর্তে ‘মম ব্রেইন’ পর্যায়ে ভালো কিছুও হতে পারে, যা মায়েদের আরও সচেতন করে তোলে। বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এবং ব্যক্তিগত অনুসন্ধান থেকে ‘মম ব্রেইন’ সম্পর্কে জানাচ্ছেন রাজিয়া সুলতানা
রোকসানা (ছদ্মনাম) তার কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত চৌকস এবং চমৎকার টিম প্লেয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একজন নারী ব্যবস্থাপক হিসেবে তিনি একাধিক প্রজেক্ট, টাইট ডেডলাইন এবং ১০ জনের একটি টিমকে সাবলীলভাবে পরিচালনা করেছেন। কিন্তু প্রথম সন্তান হওয়ার পর তার সবকিছু বদলে যায়। প্রসবোত্তর প্রথম কয়েক সপ্তাহে তিনি লক্ষ করেন যে, তিনি সবকিছু ভুলে যাচ্ছেন। তিনি তার ফোনটি ভুল জায়গায় রাখছেন, সবজি ওয়াশিং মেশিনে রাখছেন, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের শিডিউল ভুলে যাচ্ছেন। এমন সব ঘটনা যা সন্তান জন্মদানের আগে ঘটত না বললেই চলে।
প্রথমে রোকসানা এই ভুলে যাওয়াকে নিছক ক্লান্তি হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি খুব অল্প ঘুমাতেন এবং নবজাতকের চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি বুঝতে পারেন যে তার মস্তিষ্ক আগের মতো কাজ করছে না।
তার ভাষায়, ‘আমার মনে হচ্ছিল আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমি সাধারণ জিনিসগুলো মনে রাখতে পারছিলাম না, যেমন আজকে সপ্তাহের কী বার, আমি সকালে দাঁত ব্রাশ করেছি কি না, খেয়েছি কি না। মনে হচ্ছিল আমার মস্তিষ্ক সবসময় এক ধাপ পিছিয়ে ছিল।’
রোকসানার মতো অনেক নতুন মা প্রসবোত্তর সময়কালে এমন মানসিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে থাকেন।
‘মম ব্রেইন’-এর পেছনের বিজ্ঞান
মম ব্রেইন কী? এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ডা. তামান্না বেগম (বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতাল, সিলেট) বলেন, ‘গর্ভকালীন এবং সন্তান প্রসব পরবর্তী (পোস্ট-পার্টাম) সময়ের অনেকগুলো জটিলতার অন্যতম হলো ‘মম ব্রেইন’। নতুন মায়েদের এ সমস্যাটি বেশি হয়ে থাকে। ‘মম ব্রেইন’ বলতে আমরা বুঝি মস্তিষ্কের অস্পষ্টতা এবং ভুলে যাওয়া। গর্ভকালীন মস্তিষ্ক ও শরীরে ব্যাপক হরমোনাল পরিবর্তন হয়ে থাকে বিশেষত অক্সিটোসিন লেভেল অনেক গুণ বেড়ে যায়। ব্রেইনের গ্রে ম্যাটার তুলনামূলকভাবে কমে যায়। তাছাড়া ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন, পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং জীবন ধারণ পদ্ধতিও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী।’
তিনি আরও বলেন, ‘হরমোনাল এবং মস্তিষ্কের এই গ্রে ম্যাটারে পরিবর্তনগুলোর প্রভাবে একজন মায়ের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন- ভুলে যাওয়া, অন্যমনষ্ক হওয়া, বাচ্চার প্রতি অমনোযোগিতা, স্ট্রেসফুল থাকা, ঘুমের অভাব, আশপাশের সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা ইত্যাদি।’
এমন রোগীর পরিবারের প্রতি তার পরামর্শ- মম ব্রেইনে আক্রান্ত রোগী তার এই হঠাৎ পরিবর্তনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন না। তাই তারা এ সময় অতিরিক্ত যত্ন ও মনোযোগ খোঁজে। সবার আগে পরিবারের সবাইকে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার দূর করে বুঝতে হবে এটা একটা অসুখ, যার চিকিৎসা রয়েছে। রোগীর পর্যাপ্ত পরিমাণে সুষম খাবার নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাকে তার প্রিয় বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে গল্পগুজব করার সুযোগ করে দিতে হবে। আগে মম ব্রেইন রোগে আক্রান্ত ছিল এমন কেউ অথবা আরও বেশি ছোট বাচ্চার মায়েদের সঙ্গে কথা বলে অভিজ্ঞতা শেয়ার করা, শারীরিক ব্যায়াম ও সিনেমা দেখা এক্ষেত্রে খুব উপকারী হিসেবে কাজ করে।
গর্ভাবস্থায় মায়ের মস্তিষ্কের গঠন পরিবর্তন
নেচার নিউরোসায়েন্সে (২০১৬) প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে বিস্ময়কর কিছু ফলাফল দেখতে পাওয়া যায়। গবেষণাটি দেখিয়েছে যে, গর্ভাবস্থা একজন নারীর মস্তিষ্কের গঠনে পরিবর্তন ঘটায়। মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অংশে ধূসর পদার্থের (গ্রে ম্যাটার) পরিমাণ কমে যায়, যা বিশেষত সামাজিক জ্ঞান এবং অন্যের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারার ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। গবেষণায় দেখা গেছে, এই পরিবর্তনগুলো প্রসব পরবর্তী দুই বছর পর্যন্ত দৃশ্যমান ছিল।
যদিও ধূসর পদার্থের (গ্রে ম্যাটার) পরিমাণ কমে যাওয়াকে উদ্বেগজনক মনে হতে পারে, তবে এটা জানা জরুরি যে এটি মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হারানোর মতো কোনো বিষয় নয়। বরং এটি বিশ্বাস করা হয় যে, এই পরিবর্তনগুলো সিনাপটিক ছাঁটাই নামক একটি প্রক্রিয়াকে প্রতিফলিত করে, যেখানে মস্তিষ্ক অপ্রয়োজনীয় স্নায়ু সংযোগগুলোকে দূর করে আরও দক্ষ হয়ে ওঠে। এই স্ট্রিমলাইনিং প্রক্রিয়াটি মূলত নতুন মায়েদের তাদের শিশুর চাহিদার ওপর ফোকাস করতে সাহায্য করে, তাদের শিশুর ইঙ্গিতগুলোয় সঠিকভাবে সাড়া দেওয়ার ক্ষমতাকে তীক্ষ্ণ করে তোলে।
গর্ভাবস্থায় মায়ের স্মৃতিশক্তি এবং মনোযোগ
নারীর গর্ভাবস্থা এবং মাতৃত্ব দ্বারা প্রভাবিত আরেকটি মূল ক্ষেত্র হলো তার স্মৃতিশক্তি। জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল নিউরোসাইকোলজি (২০০৯) এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, অনেক অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং নতুন মা তাদের স্মৃতি এবং মনোসংযোগের অসুবিধা নিয়ে কমপ্লেইন করেছেন, যা ‘গর্ভাবস্থার মস্তিষ্ক’ বা ‘মোমনেসিয়া’ হিসেবে পরিচিত। এই সমীক্ষায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে এই পরিবর্তনগুলো মায়ের মস্তিষ্কে বর্ধিত চাহিদার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে কারণ তিনি একটি নবজাতকের যত্ন নেওয়ার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে চলেছেন। কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে যে, স্মৃতি এবং মনোযোগের পরিবর্তনগুলো অস্থায়ী হতে পারে, যা প্রায়শই প্রসবোত্তর প্রথম বছরের পরেই ফিরে আসে। অন্যান্য গবেষণা ইঙ্গিত করে যে, মায়েরা নির্দিষ্ট ধরনের কিছু স্মৃতিতে ঘাটতি অনুভব করতে পারেন, যেমন অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা জরুরি কাজগুলো মনে রাখা। এ ছাড়া তারা আবেগীয় স্মৃতিতে দক্ষতা অর্জন করেন- যা তাদের সন্তানের সঙ্গে বন্ধন এবং লালনপালনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
মায়ের শরীরে হরমোনের নিরন্তর ওঠানামার খেলা
অক্সিটোসিন, যাকে ‘প্রেমের হরমোন’ বলা হয়, গর্ভাবস্থায় বৃদ্ধি পায় এবং সন্তান প্রসবের পর তা সর্বোচ্চ হয়। এই হরমোন মা এবং শিশুর মধ্যে বন্ধন, ভালোবাসা এবং কানেকশন তৈরির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে অক্সিটোসিন সহানুভূতি এবং সামাজিক জ্ঞানের সঙ্গে জড়িত মস্তিষ্কের অঞ্চলগুলোকেও প্রভাবিত করে, যা দ্বারা বোঝা যায় কেন মায়েরা তাদের শিশুর চাহিদা এবং মানসিক অবস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে যেতে পারে। অন্যদিকে, গর্ভাবস্থায় এবং প্রসবোত্তর সময়কালে কর্টিসলের মতো স্ট্রেস হরমোনও বৃদ্ধি পায়। যদিও মাঝারি মাত্রার কর্টিসল নতুন মাতৃত্বের চাহিদা মোকাবিলা করার জন্য অপরিহার্য, তবে দীর্ঘস্থায়ী চাপ স্মৃতিশক্তি এবং মনোযোগকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। হরমোনগুলোর এই দ্বৈত ভূমিকা ‘মম ব্রেইন’-এর জটিলতা এবং নতুন মায়েদের অভিজ্ঞতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সন্তান লালন-পালনের চাহিদার ভারসাম্য বজায় রাখে।
মায়ের প্রতি অভিযোগ নয়, প্রয়োজন যত্ন ও সচেতনতা
মায়েদের এইরকম মানসিক স্বাস্থ্যে মম ব্রেইনের প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এর জনস্বাস্থ্যবিষয়ক টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ডাক্তার মাকফিরাতুর রহমান তৃপ্তি। তার মতে, ‘এই সময় মা সবকিছু ভুলে যান, মায়ের কাছে মনে হয় সে যেখানে থাকার কথা সে সেখানে নেই, বর্তমানের সঙ্গে তার নিজেকে কানেক্ট করতে কষ্ট হয়। সে সবসময় এক ধরনের ভুলে যাওয়া, ধোঁয়াশা বা ঘোর লাগা, বিক্ষিপ্ত মানসিক অবস্থায় থাকেন, যা একটি সত্যিকারের অসুস্থতা। এ সময় মায়েদের মধ্যে ডিফেন্স মনোভাব লক্ষ করা যায়।’
অভিজ্ঞতায় দেখা যায় মা সারা রাত শিশুর দেখাশোনা করছে, ব্রেস্টফিডিং করাচ্ছে এরপর সকালবেলাও তাকেই আবার বাচ্চাকে দেখাশোনা করতে হচ্ছে। তার না আছে ঘুম, না খাওয়া, না গোসল, এ সময় তার মস্তিষ্ক আর কাজ করে না, সে অনেক লো ফিল করে। কোনো কিছুই তার ফেভারে থাকে না। পাশাপাশি তার ইলেক্ট্রোলাইট অনেক কম থাকে, অনেকের হিমোগ্লোবিন কম থাকে, ব্যক্তিভেদে অনেকের প্রেসার, ডায়াবেটিসসহ আরও স্বাস্থ্যগত ইস্যু থাকে। ইমোশনাল ইমব্যালান্স তো থাকেই।
প্রি-পারটাম, অ্যান্টি পারটাম এবং পোস্ট পারটাম- এই তিনটি যে গর্ভকালীন সময়কাল থাকে সেগুলোয় মাকে পুষ্টিকর খাবার দেওয়া, তাকে শারীরিক- মানসিকভাবে সাপোর্ট করা, তার বিশ্রামের ব্যবস্থা করা, ঘুমের ব্যবস্থা করা, সর্বোপরি মায়ের যত্ন নেওয়াটা জরুরি। এটি পরিবারের সদস্যের এগিয়ে আসার মাধ্যমেই সম্ভব।
বিশেষভাবে তিনি উল্লেখ করেন, ‘সব মায়ের অভিজ্ঞতা একই রকম নয়। মম ব্রেইন এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে যখন প্রেগন্যান্সি হরমোনাল ফ্ল্যাকচুয়েশন, ডিপ্রেশন, বিশ্রামের অভাব- এই তিনটি একই সঙ্গে উপস্থিত থাকে তখন খুবই কম কিছু উদাহরণ আছে যে মা পাগলও হয়ে যেতে পারেন। মা তার শিশুকে মেরে ফেলার মতো স্টেপ নিতে পারেন, নিজেও আত্মহত্যা করে ফেলতে পারেন। এরকম লক্ষণ থাকলে পরিবারকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে, মা ও শিশুর প্রটেকশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পারিবারিক-সামাজিক সচেতনতা একজন নারীকে তার মাতৃত্বকালীন মানসিক জটিলতা সফলভাবে মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে।’
জাহ্নবী