দেশে যে দুর্যোগই হোক না কেন, পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও সবসময় সেসব দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এবার স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হলো বাংলাদেশ। এই আকস্মিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে সবাই যেন এক নতুন বাংলাদেশকে দেখতে পেল। নারী-পুরুষ, তরুণ-বৃদ্ধ সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একতার যে অনন্য সেতুবন্ধন তৈরি করেছে, তা মুগ্ধ করেছে সর্বস্তরের মানুষকে। বন্যার্তদের সহযোগিতায় অবিশ্রান্ত কাজ করে যাচ্ছেন, এমন কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন মোহনা জাহ্নবী
সামিয়া আক্তার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। বন্যার্তদের জন্য কাজ করার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বন্যার্তদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবার প্রথম। এর আগে আমি এ ধরনের কোনো কাজ করিনি। অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যার কারণে যখন আমার দেশ ও দেশের মানুষের জীবন বিপন্ন, তখন বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়াতে, সহযোগিতা প্রদানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘গণত্রাণ সংগ্রহ’ কর্মসূচি ঘোষণা দেয় এবং আমি সেই কর্মসূচিতে একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করি। আমরা প্রতিদিন টিএসসি বুথে বানভাসি মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসা মানুষদের থেকে নগদ অর্থ, শুকনো খাবার, প্রয়োজনীয় মেডিসিন, শিশুখাদ্য, পোশাক, স্যালাইন, স্যানিটারি ন্যাপকিন, বিশুদ্ধ পানি গ্রহণ করে থাকি। এই সংগ্রহ করা অর্থ ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন যেসব ত্রাণসামগ্রী সংগৃহীত হয়, তা সারা দিন ব্যাপক সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবকের অংশগ্রহণে প্যাকেজিং করা হয়। প্যাকেজিং শেষে সেগুলোকে ট্রাক, পিকআপ এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় এয়ার কার্গোতে করে প্রয়োজনের ভিত্তিতে বন্যাকবলিতে এলাকাগুলোয় সরবরাহ করা হয়। আমার অভিজ্ঞতা মূলত ত্রাণ সংগ্রহ নিয়ে। আর এ ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রমে অংশ নিয়ে আমি বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই, যা আমাকে সত্যিই অভিভূত করে। এই গণত্রাণ কার্যক্রমে সারা দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এ কার্যক্রমকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। একজন রিকশাচালক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, আইনজীবী, স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী, শিশু- সবার অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরাও অর্থ প্রদানের মাধ্যমে আমাদের এই ত্রাণ সংগ্রহে অংশগ্রহণ করেছেন। অনেক আপু যাদের কাছে নগদ অর্থ ছিল না, তারা তাদের স্বর্ণালংকার যেমন- চুড়ি, কানের দুল, চেইন, আংটি দিয়ে গেছেন আমাদের কাছে এসে, যা দেখে সত্যিই আমি আবেগাপ্লুত হই। একটা জাতীয় সংকটে আমরা সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবার ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণে তা মোকাবিলা করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা যে জাতি হিসেবে কতটা ঐক্যবদ্ধ, এই ঘটনা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে এসে আমাদের কাছে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিয়ে যায় বন্যার্তদের জন্য। শিগগিরই আমরা এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব।’
স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে আমি কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হইনি। আমার প্রতি অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক ভাই ও বোনদের পূর্ণ সহযোগিতা ও সম্মান ছিল এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। যেকোনো সমস্যায় পড়লে সবাই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসে তা সমাধান করার জন্য।’
এই সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে তার প্রতি পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি বা অনুভূতি সম্পর্কে সামিয়া বলেন, ‘আমার এসব কাজে পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত ইতিবাচক। তারা আমাকে নিয়ে খুবই খুশি এবং আমার এই সামাজিক কাজে তাদের পূর্ণ সমর্থন ও দোয়া রয়েছে। আমি দেশ ও দেশের মানুষের সহায়তায় কিছু করতে পারছি ভেবেই তারা আমায় নিয়ে খুবই আনন্দিত।’
হোসনে আরা প্রাপ্তি, সরকারি শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী। বন্যার্তদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবু অনেক নারী হাসিমুখে এসব কাজ করে যাচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশ যে বন্যার মুখোমুখি হয়েছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং পার্শ্ববর্তী দেশের আমাদের প্রতি অবহেলার ফল। কেউ ভেসে যাচ্ছে স্রোতে কিংবা কারও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের মানুষ কিংবা প্রবাসী তারা কেউ পরিবার আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। এমন আরও হাজারও দুঃখ ভরা সংবাদ আমরা শুনতে পাচ্ছি। এই বিষয়গুলো আমাদের ভাবাচ্ছে। সাঁতার জানা নেই তাই বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় যেতে পারিনি। তবে ত্রাণ সংগ্রহ এবং প্যাকেজিংসহ যারা বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় যাচ্ছে তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। আমরা টিএসসিতে কাজ করছি মানুষের জন্য। ছেলেমেয়ে, ছোট-বড়, এমনকি আমাদের মা-বাবার বয়সের মানুষদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করছি। নতুন করে শিখছি অনেক কিছু। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুকনো খাবার, জামাকাপড়, খাবার স্যালাইনসহ গুরুত্বপূর্ণ পণ্য প্যাকেজিং করছি। আলহামদুলিল্লাহ। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই অনুভূতি জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতির একটি হয়ে থাকবে।’
বন্যার্তদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নানাবিধ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন প্রাপ্তি। তিনি বলেন, ‘বন্যার্তদের জন্য কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি যা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, তা হলো একতা। আমরা বাংলাদেশিরা এতটা ঐক্যবদ্ধ তা এই প্রথম অনুভব করলাম। ছোট শিশু থেকে বৃদ্ধ, শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষক, রিকশাচালক কিংবা সমাজের উচ্চবিত্ত সব স্তরের মানুষ এক হয়ে গেছে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। এই যে একতা এটা আমাকে চমৎকারভাবে প্রভাবিত করেছে। আমরা টিএসসি প্রাঙ্গণে দেখেছি কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাদের জন্য বাধা হতে পারেনি। তারা সব বাধা জয় করে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে।’
কাজ করতে গিয়ে নারী হিসেবে আলাদা করে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানুষের জন্য কাজ করছি। বানভাসি মানুষগুলো অনাহারে আছে, শিশুরা আশ্রয় খুঁজছে, একটু উষ্ণতা আর খাদ্য তাদের প্রশান্তি দিতে পারে। তাদের জন্য আমরা নারী-পুরুষ সবাই এক হয়ে কাজ করছি। এই কাজে নারী-পুরুষ একসঙ্গে একে অপরকে সহযোগিতা করছি। নারী হিসেবে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়িনি। বরং কাজের ক্ষেত্রে ছাত্ররা আমাদের সহযোগিতা করছে। বেশি ভারী কাজগুলো ছেলেরা করছে। প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে যারা ত্রাণ দিচ্ছে তাদের বেশির ভাগই ছাত্র কিংবা পুরুষ। তারা নারী, শিশু, বৃদ্ধদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। নারী হিসেবে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো আমরা সহজেই করতে পারি না। আমরা ত্রাণ সংগ্রহ করছি, প্যাকেজিং করছি, সেই কাজেও আমাদের সঙ্গে ছেলেরা সহযোগিতা করছে। সর্বোপরি আমরা নারী-পুরুষ একত্রে একটা দল হয়ে আমাদের মানুষদের, শিশুদের নিরাপদ রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে চলেছি।’
সুমাইয়া সাইনা, ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী। তার কাছে জানতে চাইলাম, এই যে বন্যার্তদের নিয়ে কাজ করছেন এসব কাজে তো সবাই আগ্রহ প্রকাশ করে না, এই মানবিক বা সামাজিক কাজের প্রতি আপনার আগ্রহ তৈরি হলো কীভাবে? উত্তরে তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েকদিন ধরে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি জীবনযাপন করছে। হাজার হাজার মানুষের ঘর ভেসে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা দেখছি পর্যাপ্ত খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানির অভাব। বৃদ্ধ নারী ও শিশুরা পড়েছে চরম বিপাকে। মৃত ব্যক্তির লাশকে ভাসিয়ে দিতে হচ্ছে জলে, কারণ দাফন দেওয়ার মতো স্থান নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। এমতাবস্থায় একজন মানুষ হিসেবে ঘরে বসে থাকা আসলেই সম্ভব নয়। সেই জায়গা থেকেই বন্যার্তদের সহযোগিতা এগিয়ে আসা।’
তার কাছে আরও জানতে চাইলাম, সবাই বলছে বাংলাদেশের এই ঐক্য আগে কখনো দেখেনি। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী? তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমাদের এই ঐক্যটা গড়ে উঠেছে। কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যখন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর দমন-নিপীড়ন চালানো শুরু হয়, তখন সারা দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করেছে। এদিকে গণ-অভ্যুত্থান সফল হতে না হতেই ভারত বাঁধ খুলে দেওয়ায় আকস্মিকভাবে বন্যা শুরু হলো। এমতাবস্থায় ভারতের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। এত বড় ত্যাগ ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যে নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, তা রক্ষা করার জন্য মানুষ পুনরায় এক হয়েছে। চরম অবক্ষয় এবং ব্যক্তি স্বার্থের যুগে এমন ঐক্যবদ্ধতা প্রমাণ করে মানুষের মধ্যে মানবিকতা ও সহনশীলতা এখনো ফুরিয়ে যায়নি।’
বন্যা প্রতিরোধে আমাদের কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে আপনি মনে করেন? এ প্রশ্নের জবাবে সুমাইয়া বলেন, ‘যেহেতু প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে আমরা অনেকগুলো নদী ভাগাভাগি করছি ফলে ভারতকে আন্তর্জাতিক নদী আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। তিস্তাসহ সব নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাঁধগুলো নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক নদী আইন মানতে হবে। সব অসম চুক্তি মূল্যায়নের মাধ্যমে পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং নতজানু পররাষ্ট্রনীতি পরিহার করতে হবে। বন্যাসহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণগুলো চিহ্নিত করে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে এবং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংসের যে প্রকল্পগুলো রয়েছে সেগুলো অবিলম্বে বাতিল করে পরিবেশবান্ধব প্রকল্পগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে।’
জাহ্নবী