ঊনবিংশ শতকে ইসলামের মূল শিক্ষার আলোকযাত্রা ভারতীয় উপমহাদেশে যিনি শুরু করেছিলেন, তিনি বেগম রোকেয়া। এই শতাব্দীতে ইরান ও মিসরের ইসলামি ভাবধারার নারীমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে রোকেয়ার চিন্তাধারার একটি বড় মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
তৎকালীন ভাবধারায় রোকেয়া যে সাহসী ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন তা সত্যিই অকল্পনীয়। স্রোতের বিপরীতে থেকে প্রথাবিরোধী কর্মকাণ্ডের মূলে কুঠারাঘাত করতে সক্ষম নারী তিনি। তার সবচেয়ে বড় অবদান মুসলিম নারীদের কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে আলোর পথে টেনে আনা। সমসাময়িক সমাজে ধর্মের নামে যে গোঁড়ামি বাসা বেঁধেছিল, সেই সঙ্গে কুসংস্কার গ্রাস করে রেখেছিল গোটা সমাজকে; মূলত বেগম রোকেয়ার সংগ্রাম ছিল তার বিরুদ্ধেই। যুগে যুগে বহু সাহসী নারী ইসলামি জ্ঞান প্রচার ও প্রসারে অবদান রেখে গেছেন, তার মধ্যে বেগম রোকেয়া অন্যতম। ইসলামি দৃষ্টিতে বিচার করলে আমরা তাকে একজন ইসলামি চিন্তাবিদ এবং ধার্মিক নারী বলতে পারি। বেগম রোকেয়ার অনেক সৃষ্টির মূলে নিহিত রয়েছে আল্লাহ ও নবিপ্রেম। তিনি চরম বিপদে মহান আল্লাহকে স্মরণ করেছেন। নারী-পুরুষকে ইসলামের মূল ধারার দিকে ধাবিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। ধর্মকে ‘Code of life’ বা জীবনবিধান করে হৃদয়ে ধারণ এবং মাথার তাজ করে নিয়েছিলেন। ‘অবরোধবাসিনীতে’ বিভিন্ন জায়গায় তাই তো তিনি মহান রাব্বুল আলামিনকে অত্যন্ত সম্মানজনক ভাষায় স্মরণ করেছেন। দুর্দশাগ্রস্ত, নিপীড়িত, অবহেলিত নারী সমাজের মুক্তির দূত হিসেবে তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য কামনা করেছেন। ইনশাআল্লাহ বলা, কারও মৃত্যুতে দোয়া পড়া, সুবহানাল্লাহ বলা এগুলো তার বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি অসাধারণ প্রেম থেকে তিনি বলেন-
‘তামাম জাহান যদি হয় একদিকে,
কী করিতে পারে তার আল্লাহ যদি থাকে।’
ড. মাহবুবা রহমান, ইসলামে নারী ও বেগম রোকেয়া গ্রন্থে (ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ১৫) লিখেছেন, আমাদের সমাজে বেগম রোকেয়াকে নিয়ে দুই ধরনের ভুল বোঝাবুঝি বিদ্যমান। প্রথমত, যারা ইসলাম ও ইসলামি পুনর্জাগরণকে সহ্য করতে পারেন না, তারা রোকেয়াকে ইসলাম ও ইসলামি হিজাবের বিরুদ্ধে একটি প্রতীক হিসেবে দাঁড় করাতে চান। তারা ভুলে যান যে, বেগম রোকেয়ার আন্দোলন ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, বরং তিনি সারা জীবন ইসলামের পক্ষে কাজ করে গেছেন এবং ইসলামকে ঘিরে যেসব কুসংস্কার ও বাড়াবাড়ি বিদ্যমান ছিল, সেগুলো দূর করার চেষ্টা করেছেন। দ্বিতীয় ভুল বোঝাবুঝিটা হলো, বেগম রোকেয়াকে ঘিরে ব্যাপক অপপ্রচার। তাকে অনেক সময় নারীবাদী রমণী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং তার লেখাকে ইসলামবিদ্বেষী বলে প্রচার করা হয়, যা একেবারেই অসত্য। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হলে বেগম রোকেয়ার ছবিতে কালি দিয়ে মুখ ঢেকে দেওয়া হয়েছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের ব্যাপারেও কেউ কেউ কথা বলছেন; যা আমাদের দৈন্যের পরিচয় বহন করে। আমরা আজও তাকে কেন উপলব্ধি করতে পারিনি! এটা আফসোস ও লজ্জার বিষয় আমাদের জন্য, নারী সমাজের জন্য।
বেগম রোকেয়া ইসলামের ইতিহাসে একজন সম্মানিত নারী। তিনি সারা জীবন শালীনতা বজায় রেখে চলাফেরা করেছেন। তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ ছিল শালীনতার পক্ষে। বোরকাকে অনেকে বিরক্তিকর ভারী পোশাক হিসেবে অভিযোগ উত্থাপনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ‘অনেকে বোরকাকে ভারী বলিয়া আপত্তি করেন। কিন্তু তুলনায় দেখা গেছে ইংরেজ মহিলাদের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হ্যাট অপেক্ষা আমাদের বোরকা অধিক ভারী নহে’ (বোরকা, মতিচুর প্রথম খণ্ড)।
বেগম শামসুননাহার মাহমুদ বেগম রোকেয়ার অত্যন্ত প্রিয় একজন ছাত্রী ছিলেন। তিনি তার ‘রোকেয়া জীবনীগ্রন্থে’ লিখেছেন, ‘বেগম রোকেয়া বলিতেন, নারিকেলের চমৎকার স্বাদ তাহার দুর্ভেদ্য আবরণের ভিতরে আবদ্ধ। অন্ধ মানুষ সেই কঠিন আবরণ ভেদ করিবার চেষ্টা না করিয়া সারা জীবন শুধু ত্বকের উপরিভাগটাই লেহন করিয়া মরিল।’
ইসলামি চেতনায় তেজোদীপ্ত নারী কণ্ঠ বেগম রোকেয়া। নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন থেকে মানবজাতিকে রক্ষার জন্য ধর্মশিক্ষা অপরিহার্য বলে মনে করতেন বেগম রোকেয়া। বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সমিতির সভানেত্রীর অভিভাষণে তিনি বলেন, ‘মুসলমান বালিকাদের প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে কোরান শিক্ষাদান করা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন।’ ইসলামে নারীর উত্তরাধিকার নিয়ে যা বলা আছে সেটি বাস্তবায়নে তিনি সোচ্চার ছিলেন। নামাজ, রোজা, জাকাতের ব্যাপারেও তিনি কোরআনের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন। যা তার অনেক লেখায় উঠে এসেছে। মেয়েদের কোরআন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি ‘ধ্বংসের পথে বঙ্গীয় মুসলিম’ প্রবন্ধে মন্তব্য করেন, ‘ছেলেবেলায় মা’র মুখে শুনতম কোরান শরীফ ঢাল হয়ে আমাদের রক্ষা করবে। সে কথা অতি সত্য, অবশ্য তার মানে এ নয় যে, খুব বড় আকারের সুন্দর জেলদ বাঁধা কোরানখানা আমার পিঠে ঢালের মতো করে বেঁধে নিতে হবে। বরং আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এই বুঝি যে, কোরান শরীফের সর্বজনীন শিক্ষা আমাদের নানা প্রকার কুসংস্কারের বিপদ থেকে রক্ষা করবে। কোরান শরীফের বিধান অনুযায়ী ধর্ম-কর্ম আমাদের নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন থেকে রক্ষা করবে।’
বর্তমান সমাজের অবস্থা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, নৈতিকতার অভাবে সমাজে অস্থিতিশীলতা, বিশৃঙ্খলা, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা বেড়েই চলেছে। সমাজও অধঃপতনের দিকে ছুটছে। দেশের ক্রান্তিকালে জাতিকে নৈতিক শিক্ষায় বলীয়ান হওয়াটা জরুরি। সেই ১০০ বছর আগের তৎকালীন সমাজ নিয়ে বেগম রোকেয়ার দর্শন, যা উপলব্ধি করলে আজও বিস্মিত হতে হয়। তিনি কতটা এগিয়েছিলেন তা আধুনিক সময়ে এসেও অনুধাবন করতে হয়। পশ্চাৎপদ সমাজে স্রোতের বিপরীতে চলার সাহস ও গরিমা দেখানোর স্পর্ধা বেগম রোকেয়া দেখাতে পেরেছিলেন। বেগম রোকেয়া দুর্নিবার হয়ে জেগে থাকুক প্রত্যেক নারীর হৃদয়ে।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, খবরের কাগজ
বেগম রোকেয়া পদক ২০২১ প্রাপ্ত এবং স্থানীয় সরকার গবেষক
জাহ্নবী