বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্যের মানদণ্ডে কারা ভালো পুরুষ নাকি নারীরা? এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো খুব অল্প সময়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আবার এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কও হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক সাফল্যের কথা বললে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা যে ঢের এগিয়ে এমনটা হয়তো বলা যায় নির্দ্বিধায়।
ক’দিন আগে নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের সপ্তম আসরের প্রসঙ্গে আসা যাক। নানা বাধা ও চ্যালেঞ্জ জয় করে সেই আসরে চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরেছে বাংলাদেশ। টানা দ্বিতীয়বারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব নিজেদের কাছে রেখেছেন সাবিনা খাতুনরা। এর আগে ২০২২ সালে নারী সাফের ষষ্ঠ আসরেও চ্যাম্পিয়ন হন বাংলার মেয়েরা। ২০১৬ সালের আসরে হয় রানার্সআপ। অথচ বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল সাফে সেরা হতে পেরেছে মাত্র একবার। সেটাও সেই ২০০৩ সালের আসরে। এরপর ২০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু পুরুষদের জন্য সাফ শিরোপা হাহাকারের নাম হয়ে আছে। ২০০৫ সালের পর বাংলাশের ছেলেরা আর সাফের ফাইনালে খেলতে পারেননি। বলা যায় বাংলাদেশের ফুটবলে এটি এখন চিরন্তন দুঃখের নাম হয়ে উঠেছে। এই দুঃখটাই নিয়মিত সাফল্যের আবির এঁকে ভুলিয়ে দিচ্ছেন মেয়েরা।
ফুটবল থেকে ক্রিকেটে চোখ ফেরানো যাক। সদ্যই টেস্ট আঙিনায় নিজেদের পথচলায় দুই যুগ পূর্ণ করল বাংলাদেশ। দুই যুগ মোটেও অল্প সময় নয়। অথচ এ সময় বাংলাদেশে পুরুষ ক্রিকেট দল পারেনি কোনো বৈশ্বিক আসরে শিরোপা জিততে। হ্যাঁ, একটি শিরোপা এসেছে। সেটি ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। তবে সেটি আসলে একটি বয়সভিত্তিক আসর। সিনিয়র পর্যায়ে প্রাপ্তির খাতা শূন্যই। সান্ত্বনা বলতে ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলা। টেনেটুনে হয়তো এই তালিকায় ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলাটাও যোগ করা যাবে। আর আসবে এশিয়া কাপে তিনবার রানার্সআপ হওয়াটা। এই তিন রানার্সআপ ট্রফির সবশেষটি এসেছিল ২০১৮ সালে। ঠিক ওই বছরই বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল গড়েছিল ইতিহাস। ভারতের আধিপত্য ক্ষুণ্ন করে এশিয়া কাপের ট্রফি নিজেদের করেছিলেন সালমা খাতুন, জাহানারা আলমরা। নারী-পুরুষ মিলিয়েই যা বৈশ্বিক আসরে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিরোপা।
ক্রিকেট-ফুটবলের বাইরে অন্যান্য খেলাতেও পিছিয়ে নেই মেয়েরা। দক্ষিণ এশিয়ার অলিম্পিকখ্যাত এসএ গেমসের প্রসঙ্গেই আসা যাক। ২০১৯ সালে নেপালের কাঠমান্ডু ও পোখারায় অনুষ্ঠিত সবশেষ এসএ গেমসে নিজেদের ইতিহাসে রেকর্ড সর্বোচ্চ ১৯টি স্বর্ণপদক জিতে বাংলাদেশ। এই সাফল্যে মেয়েদের প্রতিনিধিত্বই ছিল বেশি। মেয়েদের দলগত ও ছেলেদের দলগত ইভেন্টে সমান ৩টি করে স্বর্ণ এসেছিল। মিশ্র দলগততে এসেছিল ২টি স্বর্ণ। আর ব্যক্তিগত ইভেন্টে ছেলেরা যেখানে ৫টি স্বর্ণ জিতেছে, মেয়েরা সেখানে জিতেছে ৬টিতে। সবমিলিয়ে তাই স্বর্ণজয়ী নারী ক্রীড়াবিদের সংখ্যাটাই বেশি। ২০১৬ শিলং-গৌহাটি এসএ গেমসেও ছিল একই চিত্র। বাংলাদেশের চারটি স্বর্ণের তিনটিই এসেছিল মেয়েদের হাত ধরে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ঝান্ডা যে মেয়েরা বেশ সফলতার সঙ্গেই বইয়ে চলেছে, তা বলে দেওয়া যায় কোনো দ্বিধা ছাড়াই।
অথচ বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখনো মেয়েদের পথচলাটা মসৃণ নয়। খেলাধুলা তাদের শুরুই করতে হয় অনেক সংগ্রাম করে। সেই সংগ্রামটা পরবর্তী সময়েও চলতেই থাকে। সীমাবদ্ধতারও শেষ নেই। এসএ গেমসে স্বর্ণজয়ী কারাতেকা হুমায়রা আক্তার অন্তরা যেমন ক্রীড়াঙ্গনের পরিবেশকে এখনো মেয়েদের অনুকূলে মনে করেন না। তার কথায়, ‘মেয়েরা যেন ক্রীড়াঙ্গনে নিজেদের পুরোপুরি নিরাপদ বোধ করেন। প্রতিটি মেয়ে যেন অনুভব করে, এই জায়গাটায় সে অনেক নিরাপদ। আমি যেমন আমার পরিবারে নিরাপদ বোধ করি, আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ বোধ করি, ক্রীড়াঙ্গনটাও তেমন হওয়া উচিত।’ অন্তরা মনে করেন, ‘মেয়েরা যখন এই জায়গাটা পুরোপুরি নিরাপদ বোধ করবেন, তখন অভিভাবকরাও উৎসাহিত হবেন তার বাচ্চাদের খেলাধুলায় দিতে। অনেকেই কিন্তু মেয়েদের খেলাধুলায় পাঠান না, কারণ সবাই আসলে নিশ্চিত না, তার মেয়েটা এই পরিবেশে নিরাপদ থাকবে কি না। খেলাধুলার জায়গাটা অনেক নিরাপদ- এটা যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে দেখবেন অনেক ভালো ভালো পরিবারের মেয়েরা খেলতে আসবেন। এখন কিন্তু সেই মেয়েরাই শুধু আসে, যাদের কেবল অনেক ইচ্ছে, অনেক আগ্রহ। সব বাধা পেরিয়ে তারা আসতে চায়। কিন্তু এর বাইরে অনেক মেয়েই আছে, যারা প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও আসতে পারে না শুধু পরিবেশের কারণে।’
ক’দিন আগে বাংলাদেশের মেয়েদের সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের প্রসঙ্গ টেনে অন্তরা বলেন, ‘সাফে আমাদের মেয়েরা এত ভালো রেজাল্ট করলেন। কিন্তু ওদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন অনেক কমেন্ট আমি দেখেছি, যেখানে অনেকেই বলেছেন, মেয়েরা কেন এরকম পোশাক পরে খেলবে? এখনো মেয়েদের পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, মেয়েদের চলাফেরা নিয়ে কথা হয়। যা খুবই দুঃখজনক’।
সাবেক ফুটবলার, বর্তমানে ফিফা রেফারি ও বিকেএসপির কোচ জয়া চাকমা তুলে ধরেছেন অন্য আরও কিছু সীমাবদ্ধতরার কথা। ক্রীড়াঙ্গনের সাফল্যে এই নারী মনে করেন, ‘মেয়েরা যে পরিমাণ পরিশ্রম করেন, সেই অনুপাতে অর্থ তারা পান না। ফুটবলে মেয়েরা ভালো করে চলছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বড় ক্লাবগুলো মেয়েদের দল করছে না। যে কারণে মেয়েদের খেলার জনপ্রিয়তা যেমন হওয়া উচিত, প্রচার-প্রসার যেমন হওয়া উচিত, সেটা হচ্ছে না।’ জয়া আরও মনে করেন, ‘মেয়েদের এখন কিছু একাডেমি গড়ে উঠেছে। কিন্তু তারা ওভাবে ইনস্টিটিউশনাল ট্রেনিং দিতে পারছে না। এটা যদি না হয়, তাহলে মেয়েদের সঠিক উন্নতিটা হবে না, খেলার মান বাড়বে না। আমাদের দেশে এখন মেয়েদেরও অনেক ‘খ্যাপ’ খেলা হয়। এসব খেলায় গিয়ে অনেক খেলোয়াড় আহত হন। এতে করে অনেক খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার অকালেই শেষ হয়ে যায়। অনেক মেয়ে পঙ্গুত্বও বরণ করে। এটা একটা বড় দুশ্চিন্তার জায়গা।’
জয়া খেলাধুলার পাশাপাশি মেয়েদের পড়াশোনার ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন। তার মতে, ‘আমাদের খেলাধুলার ক্যারিয়ারটা কিন্তু খুব বড় নয়। খেলাধুলা শেষেও যে একটা ক্যারিয়ার আছে, যেমন কেউ কোচ পারে বা রেফারি, এই দিকে মেয়েদের মধ্যে এখনো সচেতনতা আসেনি। তারা মনে করছে, খেলাটাই শেষ। মানসিক একটা ব্যারিয়ার তৈরি হয়েছে, যার বাইরে মেয়েরা চিন্তা করতে পারছেন না। কিন্তু শুধু মেয়েরা ভালো খেললেই যে খেলাটা এগিয়ে যাবে বিষয়টি তা নয়। মেয়েদের টিকে থাকতে হলে দক্ষ নারী সংগঠক, নারী কোচ, নারী রেফারিও উঠে আসতে হবে। দূরদর্শী চিন্তা থাকতে হবে এবং সেই সঙ্গে থাকতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।’
জয়া যোগ করেন, ‘এখন আমাদের জাতীয় দলের বেশ কয়েকজন মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, তবে সংখ্যাটা অল্প। আমাদের মেয়েরা যদি খেলাধুলার পাশাপাশি পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, তাহলে স্পোর্টসে মেয়েদের শক্তিশালী কমিউনিটি তৈরি হবে।’
জাহ্নবী