জান্নাতুল ফেরদৌস ঢাকার হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী। যিনি বইয়ের আলোয় মানুষকে আলোকিত করতে নিজ অর্থায়নে দেশের ৭০টি পাঠাগারে বই পাঠিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে এবং একাধিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মানুষের সহায়তায় কাজ করছেন। বই মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য তৈরি করেছেন দুর্দিন ম্যাগাজিন বুকশপ। তা নিয়ে এবারের আয়োজন। লিখেছেন ফারজানা ফাহমি
মূলত বাড়িতে বই দেখতে দেখতেই বড় হয়েছেন জান্নাতুল। বাবা-মাকে ছোট থেকেই দেখেছেন সাধ্যমতো মানুষের সহায়তা করতে এবং গরিব-দুঃখীদের পাশে দাঁড়াতে। পারিবারিকভাবে সেরকম একটি আবহ ও শিক্ষাই মূলত তাকে মানুষের জন্য কাজ করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিত। সব সময়ই তিনি তাদের পাশে দাঁড়াতে চাইতেন। সেই মনোভাব থেকেই স্থায়ীভাবে কিছু করার চিন্তা মাথায় আসে। ২০১৯ সালে তিনি এবং তার কয়েকজন বন্ধু মিলেই সূর্যশিখা ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন।
তিন বছর এ ফাউন্ডেশন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন জান্নাতুল। প্রাথমিকভাবে ঢাকার রমনা পার্কে ছিন্নমূল শিশুদের বিনামূল্যে সপ্তাহে দুদিন পাঠদান ও শিক্ষা সরঞ্জাম বিতরণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজের যাত্রা শুরু হয়। এ ছাড়া বিনামূল্যে ব্লাড ক্যাম্পেইন কর্মসূচি, রক্তদাতা খুঁজে দেওয়া, অসহায় পরিবারে ঈদ ও রমজানের সময় বাজার করে দেওয়া, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে শীতবস্ত্র বিতরণ, পথশিশু ও শ্রমজীবী মানুষকে নিয়ে পিঠা উৎসব, মৌসুমি ফল খাওয়ানোর উৎসব, ছোট পরিসরে কর্মসংস্থানের সুযোগ, অসহায় ব্যক্তিদের চিকিৎসা সহায়তাসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন তিনি। উল্লেখ্য, সে সময় সূর্যশিখা সংগঠন থেকে ফুলের বিনিময়ে আহার নামে একটি প্রকল্প চালু ছিল। রমনা পার্কে ফুল বিক্রি করে যেসব শিশু জীবিকা নির্বাহ করত, সপ্তাহে দুদিন তাদের একটি ফুলের পরিবর্তে বিনামূল্যে খাবার খাওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো। করোনাকালীন প্রায় দুই শতাধিক পরিবারে তারা বিনামূল্যে খাবার ও মাসিক বাজার সরবরাহ করেছিলেন।
এরপর ২০২১ সালের জুনে তিনি সূর্যশিখা সংগঠনের দায়িত্ব থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন এবং বড় পরিসরে মানুষের জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। শুরু থেকেই মানুষের জন্য কাজ করার নেশায় বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত থেকে কাজ করেছেন জান্নাতুল। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা পথশিশু কল্যাণ ফাউন্ডেশনের খিলগাঁও রেললাইনে অবস্থিত অদম্য স্কুল নং ১৪-এর শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম এলাকার বিভিন্ন আশ্রম ও বৌদ্ধবিহারে তিনি নিয়মিত শিক্ষা সরঞ্জাম ও শীতবস্ত্র বিতরণ করেছেন। মূলত পাহাড়ে শিক্ষার আলো ও তাদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যেই তিনি এ কাজ করছেন।
এ ছাড়া শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ অর্থাৎ শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে হুইলচেয়ার বিতরণ, চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, প্রতি বছর শ্রমজীবীদের নিয়ে পিঠা উৎসব পালন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে এতিমখানাগুলোতে শিক্ষা সরঞ্জাম ও শীতবস্ত্র বিতরণ করে আসছেন তিনি। সেসব স্থানে প্রয়োজনমাফিক ফ্যান-লাইট, কার্পেটের ব্যবস্থা ছাড়াও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট স্থাপন করেছেন।
অসহায় ব্যক্তিদের ছোট পরিসরে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া ও বিভিন্ন সময়ে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, বিশেষ করে নারীদের প্রজননকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়েও তিনি কাজ করে গেছেন এবং তা এখনো চলমান। মূলত নিম্নআয়ের মানুষকে এসব বিষয়ে সচেতন করাই তার মূল লক্ষ্য।
জান্নাতুলের এ কাজ করার পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনদের। তাদের সহায়তা ছাড়া তার এতদূর এগোনো কখনোই সম্ভব ছিল না। সঠিক তথ্য ও পরামর্শ দেওয়া, অর্থ দিয়ে সহায়তা করাসহ তারা সবাই জান্নাতুলের পাশে ছিলেন বলেই তিনি এতদূর অগ্রসর হয়েছেন।
ঢাকার মগবাজারে খুব সাধারণ একটি পরিবারেই বেড়ে উঠেছেন জান্নাতুল। তার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা এবং মা গৃহিণী। বাবা-মা এবং তার ছোট ভাইকে নিয়েই তার পরিবার। তার বাবা ভীষণ বইপড়ুয়া একজন মানুষ। এ ছাড়া বাড়িতে কম-বেশি সবাই বই পড়তে ভালোবাসেন। তাই ছেলেবেলা থেকেই বইয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে তার।
করোনার সময় তিনি দুইবার কোভিড আক্রান্ত হন। সে সময় বই তাকে মানসিকভাবে শক্ত থাকতে অনেক সাহায্য করেছিল। আর ঠিক তখন তার মনে হয়েছিল, তার পড়া এ বইগুলো তিনি সেসব মানুষের কাছে পৌঁছাতে চান যারা বই পড়তে আগ্রহী কিন্তু হয়তো কোনো কারণে পারছেন না।তার বাড়িতে প্রায় ৫ হাজার বই ছিল। সুস্থ হয়ে তিনি ধীরে ধীরে বিভিন্ন পাঠাগারের খোঁজ করতে থাকেন, যেসব পাঠাগারে পাঠক থাকলেও প্রয়োজনীয় বই নেই, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনামূল্যে তার বাড়ির সংগ্রহে থাকা বইগুলোই পাঠাতে শুরু করেন। আর এভাবেই ২০২১ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন পাঠাগারে বিনামূল্যে বই পাঠানোর যাত্রা শুরু করেন। বর্তমানে তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ৭০টি পাঠাগারে বিনামূল্যে বই পাঠিয়েছেন।
বই নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে তার বড় একটি অনুপ্রেরণার জায়গা নিউইয়র্ক প্রবাসী বিশিষ্ট সাংবাদিক, মানবিক ব্যক্তিত্ব ও পাঠাগার আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক শেখ সিরাজুল ইসলাম। যিনি নিজে দেশের বাইরে থাকা সত্ত্বেও সব সময় দেশের মানুষকে নিয়ে ভাবেন। তরুণ সমাজকে বইমুখী করার জন্য তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাকে দেখেই তিনি ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
বইয়ের প্রতি ভালোবাসার জায়গা থেকেই ২০২১ সালে এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়েই মাত্র ২ হাজার টাকা পুঁজিতে দুর্দিন ম্যাগাজিন বুকশপের যাত্রা শুরু করেন তিনি। সেই থেকে বুকশপের সব কাজ তিনি পরিচালনা করছেন। স্বেচ্ছাসেবী জীবন তথা সাংগঠনিক কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন। বিভিন্ন সময়েই সাহায্যের নামে মিথ্যা তথ্য দিয়ে হয়রানি ছিল যার মধ্যে অন্যতম।
অনেক স্থানেই নিরাপত্তা না থাকার কারণে কাজ করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে এসেছেন এবং বিভিন্ন সময়ে কাজের বাইরে ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও অযাচিত মন্তব্য এর শিকার হয়েছেন। তারপরও তার পরিবারের সমর্থন বিশেষ করে তার মায়ের সার্বক্ষণিক সাপোর্ট ছিল বলেই তিনি এতদূর আসতে পেরেছেন। ভবিষ্যতে জান্নাতুল একজন প্রাণীবিদ এবং গবেষক হিসেবে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য বৃহত্তর পরিসরে কাজ করতে চান। এ ছাড়া সমাজসেবায় নিয়োজিত থেকে তিনি আমৃত্যু মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চান।
/ফারজানা ফাহমি