বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস আজ। পিরিয়ড, মাসিক বা ঋতুস্রাব প্রত্যেক নারীর স্বাভাবিক জীবনচক্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ সময়কালের মধ্যে নারীর সন্তান ধারণের সক্ষমতা থাকে। তাই এই বিশেষ সময়ে নারীদের সচেতন থাকা প্রয়োজন। তা নিয়ে এবারের আয়োজন। লিখেছেন ফারজানা ফাহমি
২০১৪ সালে জার্মানিভিত্তিক এনজিও ওয়াশ ইউনাইটেড বিশ্বব্যাপী কন্যাশিশু ও নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে চালু করেছিল এই দিবসের। ঋতুচক্র গড়ে প্রতি ২৮ দিন পরপর ঘটার ফলে ২৮ তারিখটিকে গ্রহণ করা হয় দিবসটি পালনের জন্য। ঋতুস্রাব বা মাসিকের কারণে কোনো নারী যেন তার স্বাভাবিক জীবনে পিছিয়ে না পড়েন তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এ প্রতিপাদ্যটি ঠিক করা হয়েছে। মাসিক ও মাসিকের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর মে মাসের ২৮ তারিখ সারা বিশ্বে মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস পালন করা হয়। মাসিক স্বাস্থ্যবিধি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অর্থাৎ সামগ্রিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করে। মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নারীর প্রজনন জীবনে বিশাল ভূমিকা পালন করে। তাই দিবসটির উদ্দেশ্য হলো বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে ঋতুস্রাব, মাসিক বা পিরিয়ডকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয় এবং পিরিয়ডের সঙ্গে সম্পর্কিত রোগের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাসিক নারীদের প্রজনন প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে। সাধারণত ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সেই মেয়েদের মাসিক শুরু হয়। গড়ে ২৮ দিন পরপর এটা হয়ে থাকে। এ মাসিক চক্রটা কারও কারও ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে ২১ বা ৩৫ দিন পরও হতে পারে। তবে ৫০ থেকে ৫২ বছর বয়সে নারীদের মাসিক চক্র বন্ধ হয়ে যায়। শারীরিক গঠন বা বৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে কারও ক্ষেত্রে এই সময়ের তারতম্য হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে এখনো মাসিককে একটি লজ্জা বা ভয়ের বিষয় হিসেবে ধরা হয়। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ বয়সী মেয়েদের জন্য মাসিকের প্রথম অভিজ্ঞতা বেশ ভয়াবহ ও বিব্রতকর হয়ে থাকে। পিরিয়ডের সময় অনেকেই ভয় ও লজ্জায় কাউকে কিছু জানায় না। এটি পরবর্তী সময়ে কিশোরীর মানসিক ও শারীরিক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নারীর স্বাভাবিক জীবনচক্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ পিরিয়ড। এর সঙ্গে সন্তান ধারণের সক্ষমতা সম্পর্কিত। এই স্বাভাবিক এই বিষয়টি এখনো বাংলাদেশে স্বাভাবিক আলোচনার বিষয় নয়। এখনো এ বিষয়গুলোকে গোপনীয়, একান্ত মেয়েলি বলে গণ্য করা হয়। মাসিক নিয়ে অনেক কুসংস্কার সমাজে প্রচলিত আছে। যেহেতু পিরিয়ড সময়কালের মধ্যে নারীর সন্তান ধারণের সক্ষমতা থাকে। তাই এই বিশেষ সময়ে নারীদের সচেতন থাকা প্রয়োজন।
কেন মাসিক চলাকালীন পরিচ্ছন্নতা গুরুত্বপূর্ণ?
সংক্রমণ প্রতিরোধ: মাসিক চলাকালীন যোনিপথের pH লেভেল পরিবর্তিত হয় এবং এটি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য আরও সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা এই ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
অস্বস্তি কমানো: পরিচ্ছন্ন না থাকলে চুলকানি, জ্বালাপোড়া এবং দুর্গন্ধের সমস্যা হতে পারে।
আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি: পরিচ্ছন্ন থাকলে মানসিকভাবে আরামদায়ক অনুভূতি হয় এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।
পিরিয়ডকালীন শারীরিক স্বাস্থ্য সচেতনতা
বেশির ভাগ নারী ও কিশোরী মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখনো জনসমক্ষে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেন। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন ফলোআপ সার্ভে ২০১৮ (প্রকাশিত ডিসেম্বর, ২০২০) অনুযায়ী বাংলাদেশে মাত্র ৫৩ শতাংশ স্কুলছাত্রী মাসিকের ব্যাপারে জানে। ৩০ শতাংশ ছাত্রী মাসিক চলাকালে স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। ৩৪ শতাংশ কিশোরী স্কুলে মাসিকের সময় পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে। মাত্র ৬২ শতাংশ কিশোরী স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড ব্যবহার করে। স্কুল না থাকলে কিংবা বাসায় থাকলে পুরোনো কাপড়ের ব্যবহার বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে ৩৯ শতাংশ কিশোরী পুরোনো কাপড় এবং ৫৬ শতাংশ কিশোরী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে বলে জরিপে জানা যায়। এর মধ্যে ৭৯ শতাংশ কিশোরী ভালো পানি ও সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে কাপড়গুলো পুনরায় ব্যবহার করে। মাত্র ২১ শতাংশ কিশোরী এ কাপড়গুলো বাড়ির বাইরে রোদে শুকাতে পারে। এই জরিপ থেকে বোঝা যায় মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতায় আমাদের নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে।
পিরিয়ডকালীন শারীরিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আসমা-উল-হুসনা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তার পরামর্শগুলো হলো-
১।পিরিয়ডের সময় কাপড় ব্যবহার না করে স্যানিটারি ন্যাপকিন (ওয়ানটাইম কটন প্যাড) ব্যবহার করা অধিক স্বাস্থ্যসম্মত। বিশেষ করে কিশোরীরা প্রতি দুই থেকে তিন ঘণ্টা অন্তর স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তন করবে। এমনকি বাসার বাইরে স্কুল বা কলেজে থাকলেও এ কাজটি করতে হবে। অধিক সময় ন্যাপকিন পরিবর্তন না করলে জরায়ু মুখে ইনফেকশন হতে পারে। আমরা কিশোরী/অবিবাহিত নারীদের মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করি। কাপ ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি না জানা থাকলে ক্ষতির কারণ হতে পারে। তা ছাড়া কাপ ব্যবহারে দরকার সঠিক স্যানিটেশন। ঘরের বাইরে থাকলে কাপ খুলে পরিষ্কার করা কষ্টসাধ্য। সব সময় কাপ ব্যবহারের পরে ফুটন্ত গরম পানিতে ফুটিয়ে রাখতে হবে। পরিষ্কার করে হাত ধুয়ে কাপটি ধরতে হবে। সেজন্য বাইরে থাকলে মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা উচিত নয়।
২।মাসিক চলাকালীন নিয়মিত গোসল করতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। কোনো ধরনের সাবান ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ বেশির ভাগ সাবান ক্ষারীয় পদার্থ দিয়ে তৈরি। ক্ষারীয় পদার্থ ভ্যাজাইনাল এরিয়ার অ্যাসিডিক পরিবেশকে ধ্বংস করে দেয়, ফলে ইনফেকশনের ভয় থাকে।
৩। মাসিকের সময় প্রচুর পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। বিশেষ করে কিশোরীদের খাওয়া-দাওয়ায় পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। এ সময় নারীদের অনেক রক্তক্ষরণ হয়, হরমোনাল ইমব্যালেন্স হয়, মানসিক অবস্থার বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। পেটে ব্যথা, শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা, মানসিক অবসাদ, বিরক্তি দেখা দিতে পারে। তাই এ সময়ে খাওয়া-দাওয়ার বাড়তি যত্ন নেওয়াটা প্রয়োজন। মাছ, মাংস, ডিম, বাদাম, তরল খাবার বেশি খেতে হবে, ফলমূল খেতে হবে। যাতে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে পাশাপাশি শারীরিক পুষ্টি নিশ্চিত হয়।
৪। পিরিয়ডের সময়ে হালকা ব্যায়াম, সাধারণ গতিতে ৪০ থেকে ৫০ মিনিট হাঁটা খুব দরকার। ফলে পিরিয়ডের সময়ে ভারী রক্তপাত, তলপেটে ব্যথা, ব্যাক পেইন ইত্যাদি কমে যাবে। আবার যাদের কম রক্তপাত হয় তাদের ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক রক্তপাত হবে। কারণ হাঁটার ফলে শরীরে একটা হরমোনাল রিসাইক্লিং হয়, মস্তিষ্ক থেকে এন্ডোরফিন হরমোন বের হয়, যেটি আমাদের মধ্যে একধরনের সুখানুভূতি তৈরি করে যা শরীরকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখে, মানসিক অবসাদ কাটাতে সাহায্য করে। তবে এ সময় ভারী ব্যায়াম, সাঁতার, সাইকেল চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫। মাসিক চলাকালীন অনেকের প্রচণ্ড তলপেট ব্যথা, কোমর ব্যথা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। এ ছাড়া হট কম্প্রেশনও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
৬।অনিয়মিত মাসিক, অতিরিক্ত রক্তপাত অথবা তীব্র ব্যথাসহ যেকোনো জটিলতায় অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
মাসিক চলাকালীন নারী শরীরের হরমোনাল পরিবর্তন হয়। এই হরমোনটির নাম ইস্ট্রোজেন হরমোন, এটি প্রধানত স্ত্রী হরমোন। একটি মাসিক চক্র শেষ হলে ইস্ট্রোজেন ক্ষরণ অল্প অল্প করে বাড়তে থাকে। ১৪-১৫ দিনের মাথায় তা পৌঁছে যায় সর্বোচ্চ মাত্রায়, যাকে বলে ওভুল্যাশন। এরপর দ্রুত কমতে থাকে ইস্ট্রোজেন নিঃসরণ। আবার পরের মাসিকের শুরুর পর থেকে অল্প অল্প করে নিঃসরণ বাড়ে। ইস্ট্রোজেনের এই উত্থান-পতনই মেয়েদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন বা মুড সুইংয়ের জন্য দায়ী। এটি প্রি-মিনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম সংক্ষেপে পিএমএস Premenstrual Syndrome (PMS) নামে পরিচিত।
এ বিষয়ে এ সময় মুড সুইং হয়। তবে গর্ভাবস্থায় ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিবর্তন খুব বেশি হয়। এমনকি সন্তান প্রসবের পরেও ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে মুড সুইং দেখা যায়। নিয়মিত মাসিক চলাকালীনও ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিবর্তনের কারণেই মুড সুইং হয়। প্রি-মিনস্ট্রুয়াল সিনড্রোমের মধ্যে অবসাদ, হঠাৎ রেগে যাওয়া, উদ্বেগ, মানসিকভাবে ভেঙে পড়া, অস্থিরতা, হতাশা ইত্যাদি লক্ষণগুলো রয়েছে। বেশির ভাগ নারীর ক্ষেত্রেই এ ধরনের সমস্যাগুলো কম-বেশি দেখা যায় এবং এ বিষয়গুলো মাসিক চক্রাকারে চলতে থাকে। প্রতি মাসে মাসিক শুরুর এক সপ্তাহ আগ থেকেই অর্থাৎ মাসিকচক্রের ১৪ থেকে ২৮ দিনের মধ্যেই পিএমএস হয়। এ সময় যে শুধু মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হয় তা নয় বরং শারীরিক নানা সমস্যা দেখা দেয় যেমন মাইগ্রেন বা মাথা ধরা, খাবার অনিচ্ছা, বমি হওয়া, অ্যাসিডিটি ইত্যাদি। তাই এ সময় নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য তথা সার্বিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।
মাসিক হলো একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া তাই এ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকলে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা সম্ভব। মাসিক সম্পর্কে কোনো ধরনের লজ্জা বা অস্বস্তি বোধ করা উচিত নয়। মাসিক চলাকালীন পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এ সময়ে পরিবার ও কাছের মানুষগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে পিরিয়ডের কথা জানানোর এবং রিল্যাক্স করার পরিবেশ থাকলে নারী অনেকটাই সুস্থ বোধ করবে। এ সময় যদি অন্তত এক সপ্তাহের জন্য একজন নারীর কাজের চাপ তার সংসারে এবং কর্মক্ষেত্রে কমানো যায় সে ক্ষেত্রে সে অনেকটাই চাপমুক্ত থাকতে পারে। সেজন্য চারপাশের মানুষের সহযোগিতা ছাড়া এর কোনো বিকল্প নেই। এজন্য মাসিক যে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং এই সময় যে নারীর শরীরে এ ধরনের স্বাভাবিক পরিবর্তনগুলো হয় সে সম্পর্কে অধিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
/ফারজানা ফাহমি