পারিবারিক আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্পত্তির উত্তরাধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিয়ে এবং বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে সব ধর্মের নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ।
পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. ময়না তালুকদার এবং সাধারণ সম্পাদক পুলক ঘটক দ্রুত এ প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বঞ্চনার অবসানের সঙ্গে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হবে বলে বিবৃতি দিয়েছে সংগঠনটি।
বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ ও বিভিন্ন আদিবাসী নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারসহ সবক্ষত্রে পুরোপুরি অধিকারবঞ্চিত হওয়ায় হিন্দু আইন সংশোধনের ব্যাপারে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমেই এটা করা সম্ভব।
জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের প্রস্তাবসহ কমিশনের সুপারিশে অনেকগুলো অসামান্য ভাল প্রস্তাবনা আছে, যা বাস্তবায়িত হলে দেশ উপকৃত হবে।
এর সঙ্গে বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের পূর্বঘোষিত ১১ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য সংগঠনটি সরকারের প্রতি বিনীতভাবে অনুরোধ জানিয়েছে।
বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের ১১ দফা-
১. হিন্দু উত্তরাধিকার আইন
প্রচলিত হিন্দু আইন সংশোধন করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের সম্পূর্ণ অবসান ঘটানো প্রয়োজন। আমাদের প্রস্তাব, পিতামাতার সম্পত্তিতে সন্তানরা (লিঙ্গপরিচয় নির্বিশেষে) সমান অধিকার পাবেন। একই সঙ্গে স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রী এবং স্ত্রীর সম্পত্তিতে স্বামী এক সন্তানের সমপরিমাণ উত্তরাধিকার পাবেন। সন্তান, স্বামী বা স্ত্রীর অবর্তমানে পরবর্তী উত্তরাধিকারী নির্ণয়ের প্রশ্নে পারিবারিক সম্পর্কের অন্যান্য সর্বস্তরে লিঙ্গসমতার নীতি কার্যকর হবে। নারী, পুরুষ বা লিঙ্গ স্বাতন্ত্র্য হওয়ার কারণে কেউ অধিকার বঞ্চিত হবেন না।
২. বসতভিটা সংরক্ষণ
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বসতভিটা ও বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতা হিসেবে হিন্দু আইনে নির্ধারিত (লিঙ্গপরিচয় নির্বিশেষে) সপিন্ড, সাকুল্য ও সমানোদক তালিকার অন্তর্গতরা ক্রম অনুযায়ী অগ্রাধিকার পাবেন। সম-অধিকারপ্রাপ্ত শরিকদের অনাপত্তি ছাড়া হিন্দু আইনের আওতাভুক্ত নয় এমন কারও কাছে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বসতভিটা ও বাড়ি বিক্রয় করা যাবে না।
৩. ধর্মান্তরিত ব্যক্তির উত্তরাধিকার
হিন্দু আইন অনুযায়ী ধর্ম ও জাতিচ্যুত ব্যক্তি পূর্বপুরুষের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হারান। একই নিয়মে কেউ সনাতন, বৌদ্ধ, জৈন বা পরম্পরাগত ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু আইনের আওতার বহির্ভূত অন্য কোনো ধর্মে চলে গেলে তিনি উত্তরাধিকার হারাবেন। তিনি পূর্বপুরুষের ধর্ম, সংস্কৃতি, জীবনাচরণ ও পরিবার ত্যাগের সঙ্গে পূর্বপুরুষের সম্পত্তিতেও অধিকার ত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হবেন। ফলে তিনি হিন্দু আইনের আওতাধীন কোনো ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারবেন না। সব ধর্মের ক্ষেত্রেই বর্তমানে এ ব্যবস্থা চালু আছে। এ ব্যাপারে সংসদে প্রণীত সংবিধিবদ্ধ আইন না থাকলেও দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের জন্য স্বতন্ত্র পারিবারিক আইন চালু থাকায় ধর্মান্তরিতরা সম্পত্তির উত্তরাধিকার পান না। দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা, ধর্ম, সংস্কৃতি, পরিবার এবং সম্পত্তি রক্ষার প্রয়োজনে ধর্মান্তরের ক্ষেত্রে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিষিদ্ধ করে সংসদে সুস্পষ্ট সংবিধিবদ্ধ আইন পাস করা প্রয়োজন।
৪. বিবাহ নিবন্ধন
বৈবাহিক সম্পর্কের আইনগত ভিত্তি সুদৃঢ় করা, আগত বা অনাগত সন্তানদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা এবং নানাবিধ জটিলতা নিরসনের জন্য হিন্দু আইনের অন্তর্ভুক্ত সব নাগরিকের দাম্পত্য সম্পর্কের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।
৫. বহুবিবাহ নিয়ন্ত্রণ
বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু আইনে পুরুষরা স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বহুবিবাহ করতে পারেন। এর কোনো আইনগত নিয়ন্ত্রণ নেই। এ ব্যবস্থা উন্নত সভ্যতা ও জীবন-সম্পর্কের প্রতিকূল। বিশেষ কিছু ব্যতিক্রমী বাস্তবতায় আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে একাধিক বিবাহ অনুমোদিত হতে পারে। এ ছাড়া বহুবিবাহের স্বেচ্ছাচার আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।
৬. বিবাহ বিচ্ছেদ
ধর্মশাস্ত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং নারীর পুনর্বিবাহের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু আইনে নারীদের একবার বিয়ে হলে তাদের জন্য কখনো কোনো অবস্থাতেই বিচ্ছেদ নিয়ে আবার বিয়ে করার অনুমতি নেই। ফলে অনেক নারীর জীবন দুর্বিষহ ও বিপন্ন হচ্ছে। ভগ্ন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ পুরুষদের জন্যেও প্রয়োজনীয়। কিন্তু আইন না থাকায় প্রয়োজনের তাগিদে অনেকে অবৈধপন্থা অনুসরণ করছেন এবং তাতে আইনের চোখে ‘অবৈধ সন্তান’ উৎপাদন হচ্ছে। তাই প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের আইনগত বৈধতা প্রদান এবং সেজন্য সুস্পষ্ট সংবিধিবদ্ধ আইন প্রণয়ন জরুরি।
৭. বর্ণবৈষম্য রোধ
সমাজ বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় দেশের হিন্দু সমাজের মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র ও বিভিন্ন উপবর্ণের নারী-পুরুষেরর মধ্যে অসবর্ণ বিবাহ হরহামেশাই ঘটছে। কিন্তু এসব বিয়ের আইনগত বৈধতা নেই। অবৈধ বিয়ের সন্তানরাও আইনত ‘অবৈধ’ বিবেচিত হয়। অবৈধ সন্তানের পৈত্রিক সম্পত্তিতে অধিকার নড়বড়ে থাকে। এগুলো মানবের প্রতি অবিচারমূলক অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। তাই ব্রিটিশ আমলে প্রণীত Hindu Marriage Disabilities Removal Act 1946 সংশোধন করে অসবর্ণ বিবাহের আইনগত বৈধতা প্রদান প্রয়োজন।
৮. দত্তক আইন
হিন্দু আইনে সন্তান দত্তক নেওয়া বৈধ হলেও স্বামীর অনুমতি ছাড়া নারী ও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর দত্তক নেওয়ার অধিকার নেই। ছেলে দত্তক নেওয়া যায়, কিন্তু মেয়ে সন্তান দত্তক নেওয়া যায় না। প্রতিবন্ধী শিশুকে এবং ভিন্ন গোত্রের বা ভিন্ন বর্ণের শিশুকে দত্তক নেওয়া যায় না। এরকম নানাবিধ বৈষম্য নিরসন করে আধুনিক, উন্নত ও মানবিক দত্তক আইন প্রণয়ন প্রয়োজন।
৯. অভিভাবকত্ব আইন
সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে পিতা ও মাতার সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদগত প্রতিকূলতায় শিশুর প্রয়োজনীয়তাকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন।
১০. প্রতিবন্ধীদের অধিকার
বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে বিকলাঙ্গ, দৃষ্টি, বাক, শ্রবণ, যৌন ও মানসিক প্রতিবন্ধী এবং যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ রোগের মতো তথাকথিত দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পত্তির অধিকার পান না। এর নিরসন দরকার। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সবার সম্পত্তির সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা, তাদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা বিধান ও অগ্রাধিকারভিত্তিক সুযোগ প্রদান জরুরি।
১১. সংখ্যালঘু সুরক্ষা
সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ, দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন, পার্বত্য শান্তি চুক্তি ও পার্বত্য ভূমি কমিশনের যথাযথ বাস্তবায়ন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, সমতলের আদিবাসীদের জন্যে পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা জরুরি।
বিজ্ঞপ্তি/সুমন/