
অব্যাহত ভাঙনে দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা। অথচ ভাঙন প্রতিরোধে গত চার বছরে ৮ কোটি টাকা ব্যয় করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এত উন্নয়ন-কর্মকাণ্ডের পরও ঠেকানো যায়নি সৈকতের ভাঙন। উল্টো সাগরে বিলীনের পথে সৈকতের জিরো পয়েন্ট। এমন অবস্থায় ভাঙন প্রতিরোধে পাইলটিং-কাজ ছাড়াই ৬৮টি গ্রোয়েন বাঁধ ও বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণসহ আবারও ৭৫৯ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে পাউবো। তবে এসব উন্নয়ন-কর্মকাণ্ড কতটুকু বাস্তবসম্মত এবং টেকসই হবে, সে বিষয় নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সৈকতের বালু দিয়ে সৈকত উন্নয়নসহ নানা অভিযোগ উঠেছে পাউবোর বিরুদ্ধে।
স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০০ সালে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে সমুদ্রসৈকতের দূরত্ব ৪০০ মিটার থাকলেও বর্তমানে সেই দূরত্ব নেমে এসেছে প্রায় ২০০ মিটারে।
সরেজমিন দেখা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বঙ্গোপসাগরের তাণ্ডব ও অব্যাহত বালুক্ষয়ে দীর্ঘ প্রায় ১২ কিলোমিটার সমুদ্রসৈকত বিলীন হয়ে গেছে। বিলীন হওয়া অংশে ছিল দর্শনীয় স্থান নারিকেল বাগান ও জাতীয় উদ্যান। বর্তমানে ভাঙনের মুখে রয়েছে সৈকতের ট্যুরিজম পার্ক, ইসলামিয়া মাদ্রাসা পয়েন্ট, বেড়িবাঁধসহ বিভিন্ন স্পট।
এদিকে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে গাছের মূল থেকে বালু সরে যাওয়ায় বনাঞ্চলের পাশে অসংখ্য গাছ উপড়ে গেছে। এ ছাড়া সৈকত চলে এসেছে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টের ২০০ মিটারের মধ্যে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, গত চার বছর জিরো পয়েন্টের দুই পাশে কোটি টাকা ব্যয়ে জিওব্যাগে সৈকতের বালি দিয়ে তীর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে দুই কিলোমিটার এলাকায় জিওটিউব এবং জিওব্যাগ স্থাপন করা হয়, যা কিছুদিন পরেই সমুদ্রে ভেসে যায়। এ ছাড়া ২০২১ সালে ৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে সৈকতের দেড় কিলোমিটারে জিওটিউব ও জিওব্যাগ স্থাপন করা হয়। বিগত বছরের তুলনায় কম জায়গায় দ্বিগুণ ব্যয়ে স্থাপন করা হলেও এখন তা দৃশ্যমান নয়। এ ছাড়া ২০২২ সালে সৈকতের দুই কিলোমিটার এলাকায় ২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে জিওব্যাগ ও জিওটিউব স্থাপন করা হয়। সর্বশেষ চলতি বছরে ১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ১ হাজার ১০০ মিটার জিওব্যাগ ও জিওটিউব স্থাপনের কাজ চলমান আছে। তবে সেটি পর্যটকদের জন্য এখন মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। এসব জিওব্যাগ সৈকতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় সেখানে এক বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে বড় বড় কুয়া তৈরি হয়েছে। ২০২২ সালের জুলাই ও আগস্ট পর্যন্ত জিওটিউব ও জিওব্যাগের ফাঁকের কুয়ার পানিতে ডুবে মারা যায় ঢাকার বংশাল থেকে আসা নাহিয়ান মাহাদী নাফী (১৫) নামে এক কিশোর। এ ছাড়া সৈকতে গোসল করতে নেমে জিওটিউব ও জিওব্যাগের সঙ্গে ঢেউয়ের ঝাপটায় আঘাত পেয়ে আহত হয়েছেন শতাধিক পর্যটক। কেউ কেউ মৃত্যুর দুয়ার থেকেও ফিরে এসেছেন।
পাউবোর হাতে ৭৫৯ কোটি টাকার প্রকল্প
কুয়াকাটা সৈকতের ভাঙন প্রতিরোধে ২০২০ সালে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) জরিপ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদন এবং সুপারিশ অনুযায়ী পাউবো ৯৪৯ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়ন করলেও ২০২০ সালে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম সরেজমিন কুয়াকাটা এলে পরে এই প্রকল্প ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা করা হয়। এতে সৈকতের প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকায় ১৪০ মিটার পরপর ৭০ মিটার দীর্ঘ ৬৮টি গ্রোয়েন বাঁধ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সেগুলো পাড় থেকে সাগরের দিকে করা হবে বলে জানা যায়। এ ছাড়া বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা রাখা হয়েছে। তবে সর্বশেষ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা থেকে আবারও ৭৫৯ কোটি টাকা করা হয়েছে এ প্রকল্পটি। প্রকল্প তৈরির কাজ চলমান থাকলেও সেটি আদৌ কুয়াকাটার সৌন্দর্য রক্ষা করে ভাঙন প্রতিরোধ করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে কোনো পাইলটিং কাজ করা হয়নি। ফলে এর সফলতা ও বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী ও পর্যটন ব্যবসায়ীরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়া সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালিদ বিন অলীদ বলেন, ‘কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় ইতোমধ্যে আমাদের বড় একটি প্রকল্প পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে। প্রকল্পটির আওতায় ৭৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সৈকতের প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকায় ১৪০ মিটার পরপর ৭০ মিটার দীর্ঘ ৬৮টি গ্রোয়েন বাঁধ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু আধুনিক স্থাপনাও নির্মাণ হবে। আশা করছি, প্রকল্পটি শিগগিরই পাস হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে কুয়াকাটা সৈকত তার হারানো রূপ ফিরে পাবে।’
এমএ/