
চরাঞ্চলের মা ও শিশুদের ঘরের কাছে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ৫ বছর আগে জামালপুরে দশ শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতালের উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু জনবল নিয়োগ না হওয়ায় ৪ কোটিরও বেশি টাকা খরচ করে বানানো এই হাসপাতালটি এখনো পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা সত্ত্বেও স্থানীয়রা বাধ্য হয়ে গর্ভবতী, প্রসূতি ও শিশুদের চিকিৎসাসেবা নিতে জেলা সদরে ছুটে যান। এতে অবর্ণনীয় ভোগান্তি, অতিরিক্ত ব্যয় ও জীবনঝুঁকির পাশাপাশি ঘটছে প্রাণহানিও। স্থানীয়রা দ্রুত হাসপাতালটি চালুর দাবি করলেও কর্তৃপক্ষ বলছে, আপাতত আংশিকভাবে কার্যক্রম চলছে। জনবল নিয়োগ হলে সেবার পরিমাণ বাড়ানো যাবে।
জানা গেছে, জামালপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীরচর ও তুলসীরচর ইউনিয়নের চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য বারুয়ামারী এলাকায় ৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র। স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০১৬ সালে দ্বিতল স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শেষ করে। আর এটির উদ্বোধন করা হয় ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর। কিন্তু উদ্বোধনের পর দীর্ঘ পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও শুরু হয়নি এর পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম।
স্থানীয়রা প্রথমে হাসপাতাল পেয়ে খুশি হলেও প্রত্যাশিত সেবা না পাওয়ায় এখন তারা হতাশ। ১০ শয্যার হাসপাতাল ভবনটিতে দুটি চিকিৎসকের চেম্বার, দুটি নার্স রুম, ফার্মেসি, ল্যাব, ওয়েটিং রুম, কাউন্সেলিং রুম, স্টোর রুম, খাবার সরবরাহ কক্ষ, অফিস কক্ষ ছাড়াও রোগীদের জন্য সাধারণ ওয়ার্ড, এসিসংবলিত অপারেশন থিয়েটার, পোস্ট অপারেটিভ রুমসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য কক্ষ রয়েছে।
কিন্তু জনবল নিয়োগ না হওয়ায় হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা হয় না। তাই ওয়ার্ডে নেই কোনো শয্যা, অপারেশন থিয়েটারে নেই অস্ত্রোপচারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। বর্তমানে ১০ শয্যার মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রটিতে নার্স, ফার্মাসিস্ট, নৈশ্যপ্রহরী, আয়াসহ পাঁচ জন কর্মরত থাকলেও সাধারণ রোগের কিছু ওষুধ, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বিভিন্ন উপকরণ প্রদান করা ছাড়া চোখে পড়ার মতো নেই কোনো স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম।
এ ছাড়া সম্প্রতি একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শককে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে স্বাভাবিক প্রসবসেবা কার্যক্রম চলমান রাখা হয়েছে। তবে হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে পরিচালনার জন্য ২০১৯ সালে বেশকিছু পদ সৃষ্টি করা হয়। এর মধ্যে ২ জন মেডিকেল অফিসার, ১ জন মেডিকেল ল্যাব টেকনোলজিস্ট, ১ জন ফার্মাসিস্ট, ৪ জন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা, ১ জন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, ১ জন অফিস সহায়ক এবং চাহিদার ভিত্তিতে ওয়ার্ড বয় ও আয়া নিয়োগ করার কথা। পাশাপাশি চিকিৎসক ও অন্যান্য স্টাফের জন্য রয়েছে আলাদা দুটি কোয়ার্টার।
স্থানীয় বাসিন্দা রহিমা বেগম, রিনা বেগম, চম্পা বেগম, আহাদ আলী জানান, হাসপাতালটি উদ্বোধনের পর তারা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাননি। এখানে কোনো চিকিৎসক, নার্স বা অন্যান্য স্টাফ নিয়মিত থাকেন না। রোগী ভর্তি, অপারেশন ও চিকিৎসাসেবা না থাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি এই চরাঞ্চলের মানুষদের কোনো কাজেই আসছে না। সেবা কার্যক্রম না থাকায় দূরের জেলা সদর হাসপাতাল বা অন্য বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা পেতে রোগীদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়; অনেক সময় রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
এদিকে পরিপূর্ণভাবে চালুর আগেই হাসপাতাল ভবন ও কোয়ার্টারের অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে, ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সব জিনিসপত্র। স্থানীয়রা তাই ঘরের কাছে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দ্রুত এই সেবাদান কেন্দ্রটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর দাবি জানান।
জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক জুলেখা খানম বলেন, ‘জনবল না থাকায় স্থানীয়ভাবে সমন্বয় করে আংশিকভাবে সেবা কার্যক্রম পরিচলিত হচ্ছে। রোস্টার অনুযায়ী প্রতি মাসে বরাদ্দকৃত ওষুধ নিয়মিত সরবরাহ করা হলেও তা চাহিদার তুলনায় কম। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। জনবল নিয়োগ হলে প্রত্যাশিত সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে।’
জামালপুর সদর আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সারা দেশের কোনো মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ করা হয়নি। তা ছাড়া চিকিৎসক ও নার্সের সংকট রয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি খুব শিগগিরই জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা করবেন।’
স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটি চালু হলে জামালপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীরচর ও তুলসীরচর ইউনিয়ন ছাড়াও পার্শ্ববর্তী শেরপুর জেলার কয়েকটি ইউনিয়নের কয়েক লাখ চরাঞ্চলবাসী উপকার ভোগ করবে। এ ছাড়াও মাদারগঞ্জ উপজেলায় একইভাবে পড়ে আছে অপর একটি ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র এবং ইসলামপুর উপজেলায় আরও একটি মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ।