রাজশাহী অঞ্চলে এবার ভরা মৌসুমেও বাগানে আশানুরূপ মুকুল না আসায় চাষিদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, শীতকাল দীর্ঘস্থায়ী হওয়া, দীর্ঘমেয়াদি শৈত্যপ্রবাহ, অতিরিক্ত শীত ও অসময়ে বৃষ্টি হওয়ায় আমের মুকুলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। তবে ভালো ফলন পেতে আমপ্রধান এই অঞ্চলের মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে গাছ ও মুকুলের যত্ন-আত্তি নিয়ে। তাই তারা শেষ সময়ে বাগানগুলোতে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। গাছের গোড়ায় সেচ দিচ্ছেন। এদিকে এবার গাছে মুকুল কম আসায় আমের দাম ভালো পাওয়ার আশা করছেন বাগান মালিকরা।
কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী বিভাগের মধ্যে নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও নাটোরে আমের উৎপাদন পর্যায়ক্রমে বাড়ছে। এই চার জেলায় ৯৩ হাজার ২৬৬ হেক্টর জমিতে এবার আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ লাখ ৪৪ হাজার ৫২৭ টন। গত বছর এই চার জেলায় উৎপাদিত ১২ লাখ ৭ হাজার ২৬৩ টন আমের বাজারমূল্য ছিল সাত হাজার কোটি টাকার বেশি।
চলতি বছর রাজশাহী জেলায় ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমিতে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার ১৬৫ টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৩৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর জমিতে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৬৭৮ টন; নওগাঁয় ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টরে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ টন এবং নাটোরে ৫ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৭৭ হাজার ১৮৪ টন।
আমচাষিরা বলছেন, এবার রাজশাহী অঞ্চলে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত বিরতি দিয়ে কখনো মাঝারি আবার কখনো তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ছিল। টানা দুই সপ্তাহ রাজশাহী অঞ্চলে সূর্যের আলো পড়েনি। সঙ্গে ছিল উত্তর থেকে আসা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। স্বাভাবিক নিয়মে আম বাগানে মুকুল আসার জন্য যে পরিমাণ তাপমাত্রার দরকার হয়, তা এবার ছিল না। ফলে আমগাছে পর্যাপ্ত মুকুল না আসায় চলতি মৌসুমে আমের ফলন নিয়ে চাষিরা হতাশ। অনেক মৌসুমি বাগান ব্যবসায়ী আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন।
রাজশাহীর পবা উপজেলার ধর্মহাটা গ্রামের আমচাষি ফজলুর রহমান বলেন, ‘‘অনেক বছর ধরে শুনে আসছি আমের ‘অন ইয়ার’ ও ‘অফ ইয়ার’ হয়। কিন্তু কৃষিবিজ্ঞানী ও চাষিদের সচেতনতার কারণে গত কয়েক বছর ধরে ‘’অফ ইয়ার’ এবং ‘অন ইয়ার’ দেখা যায়নি। এখন প্রতিবছরই আমের ভালো ফলন হচ্ছে। কিন্তু এ বছর ভরা মৌসুমেও আমগাছে মুকুল অনেক কম।’’
রাজশাহীর বাঘা এলাকার আমচাষি সাজেদুর রহমান বলেন, ‘গত বছর গাছে প্রচুর মুকুল এলেও ঝরে গেছে। এবার অর্ধেক গাছে মুকুল আসেনি। অল্প এই মুকুল গতবারের মতো ঝরে গেলে পথে বসে যাব। তাই গাছ ও মুকুলের যত্নে ব্যস্ত সময় পার করছি। পাশাপাশি আশা করছি কয়েক দিনের মধ্যে বাকি গাছগুলোতেও মুকুল আসবে।’
আম উৎপাদন ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সাদিয়া এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম ছানা বলেন, সাধারণত ফেব্রুয়ারিতেও আমের সব মুকুল ফোটে। তবে এবার মার্চ মাসের মাঝামাঝিতেও বাগানে মুকুল কম।
ফলন কম হলেও এবার দাম ভালো পাওয়ার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘রাজশাহীর আমের প্রতি সারা দেশের মানুষের চাহিদা থাকে। কিন্তু যে বছর আমের উৎপাদন বেশি হয় সে বছর দাম কম হয়। ফলে এবার ফলন কম হলে দাম বেশি পাওয়া যাবে।’
আমের মুকুল কম আসার বিষয়ে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ফল গবেষক ড. আলীম উদ্দিন বলেন, ‘এ বছর বাগানগুলোতে মুকুল কিছুটা কম দেখা যাচ্ছে। তবে এখনো মুকুল ফুটছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গাছে মুকুল আসতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। রাজশাহীতে এবার শীত কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। তবে এখনো সময় আছে। এরই মধ্যে রাজশাহীর আম বাগানগুলোতে ৫০ শতাংশ মুকুল এসে গেছে। এ অবস্থায় এই ফলন ধরে রাখতে গাছের যত্ন নিতে হবে।’
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আম চাষ করলে উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনি সঠিকভাবে সংরক্ষণ এবং পরিবহন, রপ্তানিসহ বাজারজাত করলে কৃষকরা লাভবান হবেন। এজন্য চাষিদের যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’