জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাসেবা ভেঙে পড়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রোগীরা এসে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। কেউ চিকিৎসা পেলেও তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। শুধু পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সব চিকিৎসক বদলি হয়ে যাওয়ায় ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে মেডিকেল অফিসার এনে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। এই একজনকে জরুরি বিভাগে প্রতিদিন ৫০০ রোগীকে দেখতে হয়।
কখনো টানা ডিউটি করতে হয় ২৪ থেকে ৩০ ঘণ্টা! সেবাপ্রার্থীরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই সংকটের সমাধান প্রয়োজন। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে শুধুই মিলেছে ‘শিগগিরই সমাধানের’ আশ্বাস।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরো হাসপাতালের চিকিৎসার দায়িত্বে আছেন মাত্র তিনজন! দীর্ঘদিন ধরে জুনিয়র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ১১টি পদের মধ্যে ৯টিই খালি আছে। অনুমোদিত মেডিকেল অফিসারের সাতটি পদের মধ্যে পাঁচজন কর্মরত ছিলেন। কিছুদিন আগে তারা সবাই বদলি হয়ে যান। মেডিসিন, সার্জারি, শিশু, ইএনটি, চক্ষুসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিভাগের চিকিৎসক নেই। শুধু গাইনি ও অ্যানেসথেশিয়া বিভাগে দুজন কর্মরত আছেন। এ ছাড়া হাসপাতালের বিভিন্ন পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বদলি করা হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে এক্সরেসহ প্যাথলজি বিভাগে।
স্টোরকিপার পদ ফাঁকা থাকায় ২২ বছর ধরে ওই পদে দায়িত্ব পালন করছেন ফার্মাসিষ্ট কামরুল হাসান। এ ছাড়া আউটসোর্সিংয়ের ১৮ জনের মধ্যে একজনকে প্রেষণে সিভিল সার্জন অফিস এবং একজনকে গোপীনাথপুর হেল্থ ইনস্টিটিউটে বদলি করা হয়েছে। বাকি ১৬ জন দুই বছর ধরে বেতন-ভাতা না পাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা ক্ষেতলাল উপজেলার ইটাখোলা গ্রামের বেলি বেগম বলেন, ‘পায়ের ব্যথার কারণে হাসপাতালে এসেছিলাম। দীর্ঘসময় অপেক্ষার পরও কোনো ডাক্তার পেলাম না। এখন সদর হাসপাতালে যাব। আমি গরিব মানুষ, ক্লিনিকে ডাক্তার দেখানোর মতো টাকা তো নেই।’
হাসপাতালের মূল গেটের সামনে ঘোরাঘুরি করছিলেন ভাসিলা গ্রামের ইদ্রিস আলী। তিনি বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে আমার চোখের সমস্যা। ডাক্তার দেখাতে এসে জানতে পারি এখানে কোনো চোখের ডাক্তার নেই। এখানে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছি।’
মাসখানেক আগে সিঁড়ি থেকে পড়ে কোমরে ব্যথা পেয়েছিলেন মাহমুদপুর গ্রামের রানা হোসেন। নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘প্রথমে পাড়ার দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেয়েছি। কিছুদিন ভালো ছিলাম। এখন আবার ব্যথা বেড়েছে। ওষুধের দোকানি আমাকে ডাক্তার দেখিয়ে এক্সরে করতে বলেন। হাসপাতালে এসে অনেক সময় অপেক্ষা করেও ডাক্তারের দেখা পাইনি। হাসপাতাল থেকে জানিয়েছে এখানে এক্সরে করা যাবে না। এখন শেষ ভরসা সদর হাসপাতাল।’
চিকিৎসা নিতে আসা মিজানুর রহমান বলেন, ‘এখানে বেশিরভাগ সময় ডাক্তার পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে আমাদের দূরের হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। কয়েক দিন ধরে আমি জ্বরে আক্রান্ত। সকাল ৯টায় হাসপাতালে এসেছিলাম, সাড়ে ১২টার দিকে ডাক্তার দেখাতে পেড়েছি। এখানে আরও চিকিৎসক থাকলে আমাদের ভোগান্তি কমত।’
কথা হয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া একমাত্র মেডিকেল অফিসার ডা. মনজুর হাসান স্বাধীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার পোস্টিং বড়াইল ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কিন্তু ক্ষেতলাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক কম থাকায় আমাকে এখানে ডিউটি করতে হয়। কখনো টানা ২৪ ঘণ্টা, কখনো ৩০ ঘণ্টা ডিউটিতে থাকতে হয়। আমাদের মনোবলেরও একটা ব্যাপার থাকে। কোথাও কোনো চাকরিতে কেউ এত সময় কাজ করে বলে আমার মনে হয় না।’
তিনি বলেন, ‘রোগীরা যখন আসে তখন তাদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হয়। চিকিৎসক সংকটে আউটডোর সেবাও বন্ধ। শুধু জরুরি বিভাগেই আমাকে থাকতে হচ্ছে। প্রতিদিন আমাকে ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী দেখতে হয়। কর্তৃপক্ষ যদি পর্যাপ্ত চিকিৎসক নিয়োগ দেয়, তা হলে সবার জন্যই ভালো হবে।’
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. আতিকুর রহমান বলেন, ‘চিকিৎসক সংকটের কারণে আমাদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও এখানে প্রতিদিন গড়ে শতাধিক রোগী ভর্তি থাকেন। এ ছাড়া বহির্বিভাগেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। সেখানে রোগীর সংখ্যা থাকে গড়ে তিন থেকে সাড়ে ৩০০।’
ক্ষেতলাল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শেখ হাসিবুর রেজা বলেন, ‘চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। আশা করছি দ্রুত এ সংকট কেটে যাবে।’