
কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনের ভাগনে নাজমুল হোসেন হীরাকে চিনি চোরাচালানে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এখনো অধরা রয়ে গেছেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন ও কিশোরগঞ্জ-২ আসনের এমপিপুত্র ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য তৌফিকুল হাসান সাগর।
গত রবিবার রাতে ময়মনসিংহের গাঙ্গিনারপাড় এলাকা থেকে ছাত্রলীগের সভাপতির ভাগনে নাজমুল হোসেন হীরাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ময়মনসিংহ থেকে সোমবার (২৪ জুন) সকালে কিশোরগঞ্জ মডেল থানা হাজতে আনা হয় তাকে। এদিকে চিনি চোরাচালানের সূত্র ধরে বেরিয়ে আসে নারী কেলেঙ্কারির তথ্য। পর্নোগ্রাফি আইনে দুই মামা-ভাগনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন এক তরুণী।
চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদক, চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধ জগতে মামা-ভাগনের রাজত্বের সাম্রাজ্য বিস্তারের কথা উঠে আসছে আস্তে আস্তে। চাঁদাবাজির টাকায় চার বছরে কোটিপতি বনে গেছেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন। ঢাকার উত্তরায় কোটি টাকার দুটি ফ্ল্যাট, বৌলাই বাইপাসের কাছে নিজের নামে ৮০ শতাংশ ফসলি জমি ও জেলা শহরের বয়লা এলাকায় ব্যয়বহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি করেছেন। সভাপতির পদবি পাওয়ার পর আর কারোর সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হয়নি। ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে তিন সদস্যের কমিটি এক বছরের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেই কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সাংগঠনিকভাবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন বা কমিটি বিলুপ্তির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কর্ণপাত করছে না। এদিকে বেপরোয়া মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিকে পুঁজি করে ছাত্রলীগের সভাপতি গড়েছেন তার অপরাধের বিশাল সাম্রাজ্য। গত বছর পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার খুদিরজঙ্গল ৩ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও করিমগঞ্জ পৌর বিএনপির সহসভাপতি জুয়েলের মেয়েকে বিয়ে করেন ছাত্রলীগ সভাপতি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খুদিরজঙ্গল এলাকার কয়েকজন জানান, পারিবারিকভাবে সম্পন্ন তাদের বিয়ের খবর এলাকার সবাই জানেন।
মোল্লা সুমনের রাজনীতির হাতেখড়ি কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিকের কাছে। তবে যার মাধ্যমে রাজনীতিতে আসা, তাকে ছেড়ে বেশির ভাগ সময় কিশোরগঞ্জ-২ আসনের এমপিপুত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখেন ছাত্রলীগ সভাপতি মোল্লা সুমন। সেই সখ্য থেকে চোরাই চিনির রমরমা ব্যবসা করার জন্য বিভিন্ন কৌশলে চোরাইপথে সুনামগঞ্জ থেকে চিনি আনা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। গত ১৪ জুন শুক্রবার ভোরে বগাদিয়া তালতলা এলাকা থেকে একটি চোরাই চিনির ট্রাক আটক করে কিশোরগঞ্জ মডেল থানা-পুলিশ। চিনির ট্রাকটি ছাত্রলীগের আরেক গ্রুপ আটকে দিলে সেখান থেকে ছাড়িয়ে আনতে থানার পুলিশকে খবর দেন মোল্লা সুমনের ভাগনে নাজমুল হোসেন হীরা।
এরপর থানা থেকে চিনির ট্রাক ছাড়িয়ে নিতে ভুয়া চালান থানায় জমা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তখন চিনির ট্রাকের ড্রাইভার ও হেলপারকে আটক করা হয়। চারজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৫-৬ জনকে আসামি করে মামলা করে কিশোরগঞ্জ মডেল থানা-পুলিশ। এদিকে মামলার পরপরই চিনি চোরাচালানে ব্যাংকে ও বিকাশে টাকা লেনদেন ও বিভিন্ন কথোপকথনের স্ক্রিনশট ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পরও পুলিশ ছাত্রলীগের সভাপতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া চোরাই চিনির সঙ্গে ছাত্রলীগ সভাপতির সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকলেও তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
সূত্র জানায়, কটিয়াদি ও পাকুন্দিয়া উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলা ও গ্রামগুলোতে ভারতীয় চোরাই চিনি ছড়িয়ে দিতে একটি টিম সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যেখানে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী সহযোগীর কাজ করে যাচ্ছেন।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জে সবচেয়ে বড় চিনি চোরাচালানের ঘটনায় কিশোরগঞ্জ-২ আসনের এমপিপুত্র তৌফিকুল হাসান সাগরের হাত রয়েছে। সবকিছুই মুঠোফোনে নিয়ন্ত্রণ করেন সাগর। ইতোমধ্যে চিনি সিন্ডিকেটে জড়িত ব্যক্তিরা গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রয়েছেন। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায় ভারতীয় চিনির ব্যবসায় সহযোগিতা করছেন পাকুন্দিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তোফায়েল আহম্মেদ তুহিন। তার নেতৃত্বে চিনি বিক্রয়ের টাকা জমা রাখা হয়। এই কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন হোসেন্দী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন হিমেল, যুবলীগ নেতা রাজন মিয়া, যুবলীগ নেতা রাজিব। তারা প্রত্যেকেই কিশোরগঞ্জ-২ আসনের এমপির ঘনিষ্ঠ। তবে তাদের ভয়ে এলাকার লোকজন মুখ খুলতে চান না। সবাই এমপির লোক বলে এলাকার মানুষজন ভয়ে ভয়ে থাকে।
চিনি সম্পৃক্ততায় ভাগনে হীরাকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনকে একাধিকবার কল দিলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
চিনি চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ খবরের কাগজকে বলেন, চিনি চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমনের ভাগনে নাজমুল হোসেন হীরাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও যারা যারা চিনি চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।