টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে সিলেট, রংপুর, ফেনী, সিরাজগঞ্জ ও খাগড়াছড়ি জেলার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে সিলেটে তৃতীয় দফার বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৭ লাখ ১১ হাজার ২২৬ মানুষ।
ফেনীর দুই উপজেলায় স্থগিত করা হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষা। এ ছাড়া এই জেলায় মাছ ধরতে গিয়ে দেয়ালধসে একজনের মৃত্যু হয়েছে। খাগড়াছড়িতে ভারী বর্ষণের ফলে সদরের শালবনসহ বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। তা ছাড়া রাঙামাটির সাজেকে আটকা পড়েছেন শত শত পর্যটক।
অন্যদিকে রংপুর ও সিরাজগঞ্জে নদীপাড়ে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলায় নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে জনপদ।
আমাদের ব্যুরো, নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিরা জানান-
সিলেট
সিলেটে তৃতীয় দফায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল সোমবার (১ জুলাই) রাত থেকে সিলেট নগরী ও জেলার প্রায় ছয় উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তবে সোমবার বিকেল থেকেই সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া শুরু করে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, সিলেটে সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ ছাড়া সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত ১৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট কার্যালয় সূত্র জানায়, মঙ্গলবার সুরমার পানি কানাইঘাট পয়েন্টে, কুশিয়ারার পানি আমলশিদ, শেওলা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও শেরপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
সকালে সিলেট জেলা প্রশাসন জানায়, সিলেটে পৌরসভারসহ ৯৭টি ইউনিয়নের ১১৮৪টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। বন্যা আক্রান্ত রয়েছে ৭ লাখ ১১ হাজার ২২৬ জন মানুষ। জেলা ৬৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ৮ হাজার ৩০৮ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
প্রসঙ্গত, এর আগে ২৭ মে সিলেটে আগাম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এরপর গত ১৭ জুন ঈদুল আজহার দিন থেকে আবারও বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
তলিয়ে গেছে খাগড়াছড়ির নিম্নাঞ্চল, সাজেকে আটকা শত শত পর্যটক
খাগড়াছড়ি সদর ও দীঘিনালা উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। এ ছাড়া মাটিরাঙ্গা, মহালছড়ি ও রামগড় উপজেলায় নদী তীরবর্তী বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তা ছাড়া পাহাড়ি ঢলে স্থানীয় ছড়া ও নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে তলিয়ে গেছে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার বহু গ্রাম।
এদিকে ভারী বর্ষণের ফলে সদরের শালবনসহ বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে।
মঙ্গলবার ভোরে খাগড়াছড়ি-মাটিরাঙ্গা সড়কের সাপমারা এলাকায় পাহাড় ধসে পড়ে। এতে খাগড়াছড়ির সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ৫ ঘণ্টার প্রচেষ্টার পর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সড়কের যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। পাহাড়ধসে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে এবং প্লাবিত এলাকার বাসিন্দাদের জন্য খাগড়াছড়ি পৌর সদরে ৯টি এবং পুরো জেলায় শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তবে মালামাল চুরি যাওয়ার আশঙ্কায় অধিকাংশ পরিবারই ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাইছেন না।
অন্যদিকে টানা বর্ষণে পানিবন্দি হয়ে পড়ায় বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এইচএসসি ও আলিম পরীক্ষার্থীদের। বন্যার পানিতে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় দুর্গম এলাকার অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। যারা পরীক্ষা দিতে গেছে, তাদের ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কোমরসমান পানি পাড়ি দিতে হয়েছে।
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে দুর্গতদের জন্য খাবার ও বিশুদ্ধ পানির বন্দোবস্ত করেছে প্রশাসন।
ফেনীতে একজনের মৃত্যু, এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত
ফেনীতে মুহুরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। এতে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার এইচএসসি পরীক্ষা বাংলা দ্বিতীয় পত্র স্থগিত করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে সোমবার রাত ১২টার দিকে নদীর পাড়ে মাছ ধরতে গিয়ে দেয়ালধসে পড়ে মামুন নামে এক তরুণ নিহত হয়েছেন। তিনি ফুলগাজীর সদর ইউনিয়নের কিসমত ঘনিয়া মোড়া গ্রামের আবদুল মান্নানের ছেলে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, টানা বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে মুহুরী নদীর তিনটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। তার মধ্যে ফুলগাজী ইউনিয়নের দৌলতপুরের একরামনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশের দুটি স্থানে ও বৈরাগপুর এলাকার একটি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙনে উত্তর দৌলতপুর, দক্ষিণ দৌলতপুর, বৈরাগপুরসহ চারটি গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এ ছাড়া সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ফুলগাজী বাজার ও ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়ক প্লাবিত হয়।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদ শাহরিয়ার বলেন, নদীর পানি না কমানো পর্যন্ত ভাঙন মেরামত করা সম্ভব নয়।
রংপুরে ভাঙনের আতঙ্কে শত শত পরিবার
রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তা নদীর পানি হুহু করে বাড়ছে। এরই মধ্যে গঙ্গাচড়ায় ও কাউনিয়া চরাঞ্চলের প্রায় দেড় হাজার ঘরবাড়ি উজানের পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া নদীপাড়ের ফসলি জমি ও রাস্তাঘাটে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, উজান থেকে নেমে আসা পানি নদীতে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা অববাহিকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এই অবস্থায় তিস্তা নদীতে পানি বাড়া-কমায় ভাঙনের মুখে পড়েছে উপজেলার লক্ষ্মীটারি, কোলকোন্দ ও নোহালী এই তিন ইউনিয়নের চরাঞ্চলের শত শত পরিবার। ভাঙনকবলিত পরিবারের অনেকে নিরুপায় হয়ে বসতি সরিয়ে নিচ্ছেন। তার মধ্যে কোলকোন্দ ইউনিয়নের চর চিলাখাল মধ্যপাড়া ঈদগাহ মাঠের একাংশ ভেঙে গেছে। ভাঙন হুমকিতে রয়েছে চিলাখাল সূর্যমুখী ক্বারী মাদ্রাসা, চিলাখাল মধ্যপাড়া জামে মসজিদ, উত্তর চিলাখাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
সিরাজগঞ্জের দুই ইউনিয়নে তীব্র ভাঙন
সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি আবারও বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানিও। ফলে প্লাবিত হচ্ছে যমুনার অভ্যন্তরীণ চরাঞ্চলের ফসলি জমি।
এদিকে পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের পাঁচিল ও জালালপুর ইউনিয়নের সৈয়দপুর এলাকায় তীব্র নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের মুখে থাকা বসতবাড়ি ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন স্থানীয়রা।
এদিকে যমুনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার শাহজাদপুরসহ সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালী উপজেলার চরাঞ্চলের গ্রামগুলোর ফসলি জমি প্লাবিত হতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে চরাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল। ফলে চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে বন্যা আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, আরও কয়েক দিন যমুনা নদীর পানি বাড়বে। এতে বিপৎসীমা অতিক্রম করে ছোট থেকে মাঝারি বন্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।