খুলনায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মধ্যবয়সী সিরাজুল ইসলাম। কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই রাতের খাবারের পর তার গলা দিয়ে রক্ত আসে। ভয় পেয়ে তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে নাক, কান ও গলা বিভাগের চিকিৎসকের কাছে যান। প্রাথমিক পরীক্ষার পর চিকিৎসক তাকে বেসরকারি একটি ক্লিনিক থেকে কয়েকটি টেস্ট করিয়ে আনতে বলেন।
তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে তার কাছে ১১ হাজার ৭০০ টাকা চাওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি বেশি টাকা নিচ্ছে কি না যাচাই করতে তিনি যান নগরের সন্ধানী ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখানে একই পরীক্ষা করার জন্য চাওয়া হয় ৯ হাজার ৫০০ টাকা। সেখান থেকে পরীক্ষা করানোর পর পরিচিত এক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পারেন, তার রোগ চিহ্নিত করার জন্য এর মধ্যে অর্ধেক পরীক্ষারই প্রয়োজন ছিল না!
একই পরীক্ষার ফি দুই ক্লিনিকে ভিন্ন হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ক্লিনিক সংশ্লিষ্টরা তাকে জানান, এই টাকার মধ্যে ক্লিনিকের অংশ, চিকিৎসকের কমিশন, সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে আনার জন্য প্যাথলজি কর্মীদের কমিশনসহ আরও নানা বিষয় থাকে। ফলে প্রকৃত পরীক্ষার ফির থেকেও কয়েকগুণ বেশি গুনতে হয়।
খুলনায় এভাবে খোলামেলা কমিশন বাণিজ্যের কারণে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা ভোগান্তিতে পড়েন। অভিযোগ রয়েছে, পরামর্শ অনুযায়ী ব্যক্তি মালিকানাধীন প্যাথলজি থেকে টেস্ট না করালে অনেক সময় চিকিৎসকরা রিপোর্টই দেখতে চান না। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের চেম্বারের বাইরে বড় বড় করে লেখা থাকে, ‘এখানে বাইরের রিপোর্ট দেখা হয় না।’
নগরীর নবপল্লী এলাকার বাসিন্দা কামরুল ইসলাম জানান, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে তাকে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের পর রক্ত ও ইউরিনের তিনটি টেস্ট দিয়ে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে পরীক্ষা করানোর সামর্থ্য না থাকায় সরকারি হাসপাতাল থেকে পরীক্ষা করে রিপোর্ট নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকের রুমের ভেতর থেকে রেজা নামে এক কর্মচারী জানান, বাইরে থেকে করানো রিপোর্ট ডাক্তার দেখবেন না। খুলনা সিটি মেডিকেল হাসপাতালে চতুর্থ তলায় বহির্বিভাগে ডা. ফৌজিয়া বেগম ও ডা. মো. ইনামুল কবীরের চেম্বারের বাইরের দেওয়ালে ‘এখানে বাইরের রিপোর্ট দেখা হয় না’ লিখে নোটিশ টানানো হয়েছে।
কমিশনের টাকা চিকিৎসকের পকেটে
খুলনার একটি হাসপাতালে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন স্কুলশিক্ষক জাকিরুল ইসলাম। হাসপাতাল থেকে রোগ নির্ণয়ে আরবিএস, সিরাম ক্রিয়েটিনিন, এসজিপিটি টেস্ট, এক্স-রে, হোল এভডোমিন, ইসিজি, লিপিড প্রোফাইল, ইউরিন ও ব্লাড গ্রুপিং পরীক্ষা দেওয়া হয়। চিকিৎসকের দেওয়া প্রেসক্রিপশন নিয়ে তিনি ওই পরীক্ষাগুলো করানোর জন্য নগরীর কেডিএ অ্যাভিনিউতে বেসরকারি ডক্টরস পয়েন্ট ক্লিনিকে গেলে পরীক্ষা বাবদ চাওয়া হয় ৬ হাজার ৬০০ টাকা। একই পরীক্ষা করাতে খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাওয়া হয় ৫ হাজার ৫৫০ টাকা, সন্ধানী ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৭ হাজার ২০০ টাকা ও বেস্ট কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৭ হাজার ৫০০ টাকা।
বিভিন্ন ক্লিনিক ঘুরে পরিচিত একজনের মাধ্যমে তিনি আবারও ডক্টরস পয়েন্টে গেলে কোনো চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া তারা প্যাকেজ মূল্যে ওই পরীক্ষাগুলো মাত্র ৩ হাজার ৫০০ টাকায় করে দিতে রাজি হয়।
জাকিরুল ইসলাম জানান, তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন- প্রেসক্রিপশন বা চিরকুট (শর্ট স্লিপ) দেখে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে ওই চিকিৎসকের জন্য নির্দিষ্ট কমিশন রোগীর কাছ থেকে অতিরিক্ত নেওয়া হয়। সপ্তাহ শেষে কমিশনের টাকা চিকিৎসকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টার চিকিৎসককে কমিশন না দিলে সেখানে আর রোগী পাঠানো হয় না। চিকিৎসকরাও ওই প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট দেখতে চান না। আবার অনেক সময় রোগী পাঠানোর জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পক্ষ থেকে চিকিৎসককে অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া যে ক্লিনিকে বসে চিকিৎসক রোগী দেখেন সেখানেও চিকিৎসকের সঙ্গে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেওয়ার জন্য চুক্তি থাকে; যেন ওই ক্লিনিক লাভবান হতে পারে।
স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এভাবেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে সাধারণ রোগীরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. হুসাইন শাফায়েত বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করানোর জন্য পরামর্শ দেই। কিন্তু শক্ত সিন্ডিকেটের মুখে অনেক সময় অসহায় হতে হয়।’
স্বাস্থ্য বিভাগের উদাসীনতা
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে কেন্দ্র করে এর আশপাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই দালালদের মাধ্যমে রোগীদের প্রলোভন দেখিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে চলছে টেস্ট বাণিজ্য। সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে কমিশন পাচ্ছে দালালচক্র। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানে মানসম্পন্ন প্যাথলজি বিভাগ, ডিপ্লোমাধারী প্যাথলজিস্ট নেই। ফলে তাদের পরীক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, খুলনা নগরীতে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ২৫০টি। মাঝে মধ্যে দালালচক্রের বিরুদ্ধে হাসপাতাল-ক্লিনিকে অভিযান চালানো হলেও তা বন্ধ হয়নি।
খুলনা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা বলেন, ‘বিধি অনুযায়ী প্যাথলজি বিভাগ চালু করতে হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিপ্লোমাধারী প্যাথলজিস্ট ও একজন সুইপার রাখতে হবে। আর মাইক্রোস্কোপ, ফ্রিজ, মেডিকেল যন্ত্রপাতি, অপারেশন থিয়েটার ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। অথচ অধিকাংশ ক্লিনিকে তা নেই।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) খুলনা জেলার সম্পাদক অ্যাডভোকেট কুদরত-ই খুদা বলেন, ‘সরকারি ভবন, স্থাপনা, যন্ত্রপাতি ও লোকবল ব্যবহার করে বেসরকারি ক্লিনিকগুলো প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কমিশন বাণিজ্য করছে।’ তবে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) খুলনা জেলার সভাপতি ডা. বাহারুল আলম জানান, যারা কমিশন বাণিজ্যে জড়িত তারা অবশ্যই অন্যায় করছেন। তবে সরকারি হাসপাতালে প্যাথলজি সুযোগ বাড়াতে হবে। সেখানে জনবল, টেকনোলজিস্টের ঘাটতি রয়েছে। সরকারি হাসপাতালের প্যাথলজি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হলে অনিয়ম বন্ধ হবে।