সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার রেলওয়ে কলোনির বাসিন্দা রেশমি বেগম (২২) সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ঈদুল আজহার দিন তার ঘরে বন্যার পানি ঢোকে। তখন বাইরে হাঁটু সমান পানি। আশপাশের বেশির ভাগ মানুষ বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যান। কিন্তু রেশমি যাননি। কারণ এই শারীরিক অবস্থায় তিনি হাঁটু পানি দিয়ে যেতে পারবেন না। তার ওপর চার বছরের একটি ছেলেও আছে তার।
পানির মধ্যে ঘরেই থেকে যান তিনি। রেশমি বেগম বলেন, ‘সাত মাস (গর্ভাবস্থা) চলছে আমার। ঘর ছাড়ার সাহস পাইনি। ঈদের দিন থেকে ঘরে পানি। এই পানির মধ্যেই দৈনন্দিন কাজ করি। পায়ে ঘা হয়ে গিয়েছিল। তিন দিন হয় এক রুমের পানি কমেছে। কিন্তু বাকি দুই রুমে এখনো পানি আছে। স্বামী বাইরে থেকে বালতি দিয়ে খাবার ও গোসলের পানি ঘরে এনে দেন। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বন্যার কারণে যেতে পারছি না। পরিবার পরিকল্পনার দিদি এসে খোঁজ খবর নিয়ে যান।’
এই রেলওয়ে কলোনিতে রেশমির মতো অন্তঃসত্ত্বা নারী আছেন আরও চারজন। তাদেরও একই অবস্থা। এই কলোনিতে আছেন ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা রিমা বেগম (২৭)। গর্ভকালীন তৃতীয় ধাপে আছেন তিনি। যেকোনো সময় তার প্রসব ব্যথা উঠতে পারে। রিমা বলেন, ‘তিন দিন আগেও একবার শরীর অনেক খারাপ হয়। ডাক্তারের কাছে যাওয়া খুব জরুরি ছিল। কিন্তু সারা কলোনি পানির নিচে। রাস্তায়ও পানি। অনেক কষ্টে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছি। ডাক্তার বলেছেন ডেলিভারির তারিখ সামনের মাসে। কিন্তু এই মাসেও প্রসব ব্যথা উঠতে পারে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনের রাস্তায়ও পানি। তাই অনেক চিন্তায় আছি।’
বন্যার কারণে রেশমি ও রিমার মতো ভোগান্তি ও দুশ্চিন্তায় আছেন সিলেটের ২২ হাজার ৭৭৩ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী। তৃতীয় দফা বন্যায় দীর্ঘদিন ধরে পানিবন্দি থাকায় তারা একদিকে যেমন সুপেয় পানি, পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। ঘর থেকে দূরবর্তী শৌচাগার, ঘরের ভেতর ও বাইরের মাটি পিচ্ছিল হওয়াসহ পরিবেশগত নানা সমস্যায় তারা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।
সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে, কিন্তু ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার রেলওয়ে কলোনিতে এখনো হাঁটু পানি। রবিবার সরজমিনে দেখা হয় ফেঞ্চুগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের পরিবারকল্যাণ সহকারী প্রতিমা পালের সঙ্গে। এলাকা ভিজিট করতে গিয়ে তিনি হাঁটু পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছিলেন। প্রতীমা পাল বলেন, ‘আমার দায়িত্বে ১২টি গ্রাম আছে। এই গ্রামগুলোতে বর্তমানে ৫৫ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী আছেন। বন্যা পরিস্থিতির কারণে তারা এখন সবচেয়ে বেশি সংকটে আছেন। বাড়িতে পানি থাকায় কিছু নারী নিরাপদ আশ্রয়ে গেছেন। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি। কারণ সেখানে মানুষজন অনেক গাদাগাদি করে থাকছেন। গর্ভবতী নারীদের থাকার মতো সুব্যবস্থা নেই।’
প্রতিমা উদ্বেগের সঙ্গে জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনের রাস্তায়ও পানি। সেখানে যাওয়া ওই নারীদের জন্য অনেক কষ্টের। গত বৃহস্পতিবার রাতে লুনা আক্তার (২৬) নামে একজনের প্রসব ব্যথা উঠলে তাকে পানির কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া যায়নি। পরে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে রাত তিনটায় ডেলিভারি করানো হয়।
সিলেটের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত মে মাসের তথ্য অনুযায়ী সিলেটের ১৩ উপজেলায় অন্তঃসত্ত্বা নারী আছেন ২২ হাজার ৭৭৩ জন। এর মধ্যে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় আছেন ১০৯৯, গোয়াইনঘাটে ৩৫৯৫, জকিগঞ্জে ১৫০৯, জৈন্তাপুরে ১৮৭৭, বালাগঞ্জে ৮০৯, গোলাপগঞ্জে ১৮৮৬, সিলেট সদরে আছেন ২৭৬৬, বিয়ানীবাজারে ৮৯১, কানাইঘাটে ২০৬১, বিশ্বনাথে ১৯১১, কোম্পানীগঞ্জে ১৬১৬, দক্ষিণ সুরমায় ১৪৯৬ ও ওসমানীনগর উপজেলায় আছেন ১২৫৭ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী।
বন্যাকালে সবচেয়ে বেশি সংকটে আছেন সিলেটের সীমান্তবর্তী ৬টি উপজেলার গর্ভবতী নারীরা। কারণ ভারতের পাহাড়ি ঢলে সবার আগে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার উপজেলার নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করে। তখন পানির পরিমাণ ও স্রোত খুব বেশি থাকে। তখন সাধারণ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাই সেসব এলাকার গর্ভবতী নারীরা আরও বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকলেও গর্ভকালীন সেবা পেতে প্রচুর দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
গত ৬ জুলাই জকিগঞ্জের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে এক নারী গর্ভকালীন জটিলতায় পড়েন। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফসানা তাসলিমের সহযোগিতায় ওই নারীকে নৌকায় করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ওষুধ দিয়ে আবার আশ্রয়কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনা হয়।
বন্যায় ঘর তলিয়ে যাওয়ায় স্ত্রী আফসানা বেগমকে নিয়ে বিয়ানীবাজার উপজেলার মুড়িয়া ইউনিয়নের বাড়ুদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন বাড়ুদা গ্রামের কুনু আহমদ। গত ২ জুলাই আফসানা বেগমের প্রসব ব্যথা উঠলে আশ্রয়কেন্দ্রের অন্যদের সহযোগিতায় তাকে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। পরে নবজাতকের জন্য উপহার সামগ্রী নিয়ে তাকে দেখতে যান বিয়ানীবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী শামীম।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সিলেটের উপ-পরিচালক তপন কান্তি ঘোষ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বন্যার সময় গর্ভবতী নারীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। কিন্তু আমরা আমাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদেরকে সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে তিনজনের একটি টিম আছে আমাদের। তারা গিয়ে সেখানে সেবা দিচ্ছেন। তারপর যারা সেবাকর্মী আছেন তারা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তথ্য সেবা দিচ্ছেন। আমাদের কেন্দ্রে একটি হটলাইন নম্বর আছে, সেখান যারা কল দিচ্ছেন তাদেরকে সেবা ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের ১৩৬টি মেডিকেল টিম ফিল্ডে কাজ করছে। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে মেডিকেল টিমের নম্বর দেওয়া আছে। কোনো খবর পেলেই মেডিকেল টিম সেখানে গিয়ে সেবা দিয়ে আসে।’
নতুন মায়েদের জন্য এই সময়টা একটু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে সিভিল সার্জন বলেন, ‘একজন নারী যখন প্রথম মা হন তখন তার মাতৃত্বটা বুঝতেই অনেক সময় লাগে। এর মধ্যে সঠিক পুষ্টির একটি ব্যাপার থাকে। বন্যার মতো এই ধরনের সংকটকালীন সময়ে গর্ভবতী মায়েদের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পাওয়া যায় না। এ জন্য আমাদের মেডিকেল টিম গর্ভবতী নারীদেরকে বিনামূল্যে আয়রন, ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট সরবরাহ করছেন। আমাদের প্রতিটি কেন্দ্রেই এই ওষুধগুলো দেওয়া হচ্ছে।’