
‘বছরের পর বছর ধরে কাজ করে আইতাছি এই দোকানেই। চোখের সামনেই ৫০ বছরের সেই দোকান নদী গিলে খাইছে। এহন কই যামু এই বয়সে। কি কইরয়া খামু। পেটও তো বাঁচাইতে অইবো।’
পদ্মা শাখা নদীর ভাঙনে নিজের দোকানঘর হারিয়ে এসব কথা বলেই আক্ষেপ করছিলেন মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার দীঘিরপাড় বাজারের কামার বৃদ্ধ সুনীল মণ্ডল (৭৫)।
তিনি জানান, কিশোর বয়সেই বাবার হাত ধরে এ পেশায় আসেন। বাবার মৃত্যুর পর ৫০ বছর ধরে তার রেখে যাওয়া দোকানে লোহার সঙ্গে হাতুড়ি পেটানোর কাজ করে আসছেন।
গেল দুদিনের পদ্মা শাখা নদীর ভাঙনে দীঘিরপাড় বাজারের কামার সুনীল মণ্ডলের মতোই আরও পাঁচ কামার দোকান হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার সকালে ভাঙন শুরু হয়। শুক্রবারও ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এই দুদিনে ভাঙনে বাজারের অন্তত ১৫টি দোকান নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ওই বাজার পুরোটাই এখন ভাঙনের কবলে পড়েছে। ভাঙনের তীব্রতায় অনেকেই দোকানঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।
শুক্রবার (১২ জুলাই) দুপুরে সরেজমিনে দীঘিরপাড় বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, স্রোতের তীব্রতায় শাখা নদীর তীরের মাটি ভেঙে পড়ছে। বড় বড় ঢেউয়ের আঘাতে বাজারের তীরঘেঁষা দোকানপাটের ভিটেমাটি পড়ছে নদীর বুকে।
বাজারের পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকের ২০০ মিটার এলাকাজুড়ে সবচেয়ে বেশি ভাঙনের চিত্র চোখে পড়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ভাঙনের মুখে বাজারের কামারপট্টির ৭টি দোকানঘর, ২টি পাটের আড়ত, ২টি সারের দোকান ও ৪টি মুদি দোকান নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন কামার গৌতম মণ্ডল, দিলীপ মণ্ডল, অনীল মণ্ডল, সুনীল মণ্ডল, শ্যামল মণ্ডল, উত্তম মণ্ডল ও কালু মণ্ডল।
এ ছাড়া ভাঙনে অলি বেপারী ও আলমাছ বেপারীর পাটের আড়ত এবং নজির হালদারের ২টি সারের দোকান বিলীন হয়ে গেছে। আরও দোকান হারিয়েছেন চার মুদি দোকানি।
এদিকে, ভাঙন প্রতিরোধে চলমান স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ কাজের ধীরগতির কারণেই এ ভাঙনের কবলে পড়েছেন বলে অভিযোগ বাজারের ব্যবসায়ীদের।
তারা জানান, আড়াই যুগ ধরেই পদ্মা ও পদ্মার শাখা নদীতে বর্ষা মৌসুমে ভাঙন চলছে। ভাঙন প্রতিরোধে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয় বছর দুয়েক আগে।
জানা গেছে, জেলার লৌহজং উপজেলার খড়িয়া থেকে টঙ্গীবাড়ি উপজেলার দীঘিরপাড় বাজার পর্যন্ত পদ্মাতীরে ৪৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০২২ সালের মে মাসে। দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণে কয়েকটি ভাগে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। এর মধ্যে দীঘিরপাড় বাজারঘেঁষে বাঁধ নির্মাণ করছে সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স কোম্পানি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির নদীর তীরে জিও ব্যাগ ফেলে ও ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মাণের কথা রয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা।
দীঘিরপাড় বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাইজুদ্দিন বেপারি বলেন, ‘বর্ষা এলেই এখানে ভাঙন দেখা দেয়। অথচ শুষ্ক মৌসুমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টুকিটাকি করে বাঁধ নির্মাণ কাজ করে আসছে। আমরা এক মাসে আগেও অনুরোধ করেছি ব্লক ফেলে এখানে বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ করার জন্য। আমাদের কথা কর্ণপাতই করেনি। আজকের মধ্যে যদি জিও ব্যাগ ও ব্লক ফেলা হয় তাতেও বাজারটি রক্ষা পাবে।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিগমা ইঞ্জিরিয়ার্সের ব্যবস্থাপক মোশারফ হোসেন বলেন, ‘আগামী বছরের জুন মাস পর্যন্ত আমাদের কাজের সময় বাড়ানো হয়েছে। কাজেই যথাসময়েই বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে। আকস্মিক ভাঙন ঠেকাতে সেখানে জিও ব্যাগ ফেলা হবে।’
মুন্সীগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আর্থিক বরাদ্দ দিতে না পারার পাশাপাশি কিছু সমস্যার কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সময় বাড়ানো হয়েছে। তবে বর্তমানে আকস্মিক ভাঙন ঠেকাতে প্রতিষ্ঠানটিকে জিও ব্যাগ ফেলার জন্য বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ট্রলারে রাখা আছে। তীব্র স্রোতের কারণে জিও ব্যাগ কাজ ব্যাহত হচ্ছে।’
সাদিয়া নাহার/অমিয়/