ক্যানসার আক্রান্ত স্বামীর চিকিৎসায় সাহেরা বেগমকে এলাকাবাসী আর স্বজনদের কাছে হাত পাততে হয়েছিল। ঠাকুরগাঁও সদরের মুন্সিরহাটের এই নারীর স্বামী হোসেন আলী ছিলেন দিনমজুর। নুন আনতে পান্তা ফুরানো আর্থিক অবস্থার মাঝেই স্বামীর এই রোগ তাকে পথে বসিয়েছিল। দুবেলা চুলা জ্বালানো যখন তার জন্য সংগ্রামের নামান্তর তখন ক্যানসারের চিকিৎসা কীভাবে করবেন এই চিন্তায় দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছিলেন সাহেরা। তখনই জানতে পারেন সমাজসেবা অফিসের অনুদানের কথা।
হোসেন আলীর যে রোগ হয়েছে তার চিকিৎসায় সেখান থেকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আশার আলো দেখেন সাহেরা। আবেদন করেন। কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, অনুদানের টাকা আর আসে না। এভাবেই কেটে যায় পাঁচ মাস। এরই মধ্যে হোসেন আলী মারা যান। এর আরও কয়েক মাস পর অনুদানের টাকা আসে। কিন্তু এই টাকা দিয়ে তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না।
সাহেরা বেগম বলেন, ‘স্বামী মরার পর টাকা দিয়ে কী করব। যখন প্রয়োজন ছিল, তখন পাইনি। আমার মনে হয় সমাজসেবা অফিসের কর্মকর্তাদের অবহেলা রয়েছে। তাই সময় মতো টাকা পাইনি। তাদের কারণেই সরকারের এই মহতী উদ্যোগ থেকে আমরা গরিব মানুষ বঞ্চিত হচ্ছি।’
ক্যানসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জন্মগত হৃদরোগ এবং থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিশেষ অর্থ সহায়তার উদ্যোগ নেয় সরকার। এই রোগে আক্রান্তদের সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অনুদান দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সারা দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় এ কর্মসূচির মাধ্যমে ৫৬১ জন রোগীকে ২.৮ কোটি টাকা অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। ১০ বছরে কর্মসূচির আকার বেড়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪০ হাজার রোগী পান ২০০ কোটি টাকা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ে দুরারোগ্য এসব রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঠিক সময়ে অর্থসহায়তা দেওয়া হয় না। অনুদানের টাকা আসার আগেই অনেক রোগী মারাও যান।
কথা হয় সদরের ইজিবাইক শ্রমিক রাজুর সঙ্গে। তার বাবাও দীর্ঘদিন ক্যানসারে ভুগেছেন। অর্থসহায়তার আশায় সমাজসেবা অফিসে ঘুরে জুতা ক্ষয় হয়েছে দাবি করে বলেন, ‘আমার বাবা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন। শেষমেশ বাবার মৃত্যুর কয়েক দিন আগে টাকা পেয়েছি। ওই টাকা কোনো কাজে আসেনি। আমার বাবাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। আমার গ্রামের আরেকজন ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর স্বজনরা দীর্ঘদিন আগে টাকার জন্য আবেদন করেছিলেন। রোগী এরই মধ্যে মারা গেছেন। কিন্তু এখনো তার পরিবার টাকা পায়নি।’
নিয়ম অনুযায়ী ১৭ থেকে ১৮ কার্যদিবসের মধ্যে এই সহায়তার টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। আবেদন করার পরে অনুদানের টাকা পেতে কত দিন সময় লাগে এমন প্রশ্নে ঠাকুরগাঁও জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাইয়েদা সুলতানা বলেন, ‘কত সময় লাগে তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কারণ বরাদ্দ চলে এলে কোনো কোনো আবেদনের টাকা দ্রুত দেওয়া যায়। সাধারণত তিন মাস পরপর এই বরাদ্দের টাকা আসে।’
আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ধীরগতির বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে সাইয়েদা সুলতানা বলেন, ‘প্রথমে উপজেলা সমাজসেবা অফিসে আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়। এরপর সেগুলো জেলা অফিসে পাঠানো হয়। তারপর আবার সিভিল সার্জন অফিসে এগুলো যাচাই করার জন্য বোর্ড বসে। এ জন্য একটু সময় লাগে। তারপরও দ্রুত করার চেষ্টা করা হয়।’
আবেদন পাওয়ার পরে অনুদান দিতে কত দিন সময় লাগে এমন প্রশ্নের জবাবে সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক আল মামুন বলেন, বরাদ্দ থাকলে আবেদন যাচাই-বাছাই করে এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে অনুদানের টাকা দেওয়া যায়। যদি কারও আবেদন দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকে তা হলে অভিযোগ পাওয়া সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেব।
ঠাকুরগাঁও সিভিল সার্জন ড. নূর নেওয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এখানে এক দিনও সময় লাগে না। কাগজপত্র এলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেই। যে দিন কাগজ আসে সে দিনই ছেড়ে দেই।’