
উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত বগুড়ায় প্রতিবছর ৫ লাখ টন সবজি উৎপাদন হয়। কিন্তু সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় মোট উৎপাদনের ১০ থেকে ১৫ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায়। বাজারদর পড়ে গেলে কখনো কখনো এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়ে। কৃষকরা ক্ষতির শিকার হন।
শুধু কৃষি খাত নয়, সেন্ট্রাল ইটিপিসহ (অ্যাফলুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) অর্থনৈতিক অঞ্চল, গ্যাস ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় শিল্প-কারখানার বিকাশ হচ্ছে না। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নেতাদের পাশাপাশি শিল্পপতিরা বলছেন, এসব সংকট সমাধানের পাশাপাশি প্রকৃত উদ্যোক্তাদের ব্যাংক লোন নিশ্চিত করা গেলে এ অঞ্চলে বড় বড় শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। এতে সরকারের রাজস্ব আহরণও বাড়বে।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির খসড়া হিসাব থেকে জানা গেছে, গত ১০ বছরে বগুড়ায় পাওয়ার প্ল্যান্ট, কেমিক্যাল কোম্পানি ও সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু শিল্প প্লটের সংকটের কারণে বগুড়ায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে আছে।
বগুড়া বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক (এজিএম) এ কে এম মাহফুজুর রহমান জানান, বগুড়ায় দুটি শিল্প এলাকার প্লট অনেক বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় প্রায় ৩০০ একর জমির ওপর দুই হাজার প্লট নিয়ে উত্তরাঞ্চল কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পপার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এখানে গড়ে উঠবে দুগ্ধজাত পণ্যের কারখানার পাশাপাশি আলু, মরিচ ও মাছ প্রক্রিয়াজাত ইন্ডাস্ট্রিসহ নানা ধরনের শিল্প-কারখানা। এতে কর্মসংস্থান হবে অন্তত ১ লাখ মানুষের।
এ কে এম মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘বগুড়া শিল্প নগরীর ভেতরে থাকা ৯৪টি শিল্প-কারখানা থেকে সরকার এখন বছরে ১০০ কোটি টাকার রাজস্ব পায়। আর প্রস্তাবিত শিল্প পার্ক থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হবে অন্তত ১ হাজার কোটি টাকা। শুধু তা-ই নয়, সবজিসহ পচনশীল অনেক কৃষিপণ্য নষ্ট হওয়া বন্ধ হবে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে বলা হয়েছে, প্রতি বছর শুধু বগুড়াতেই নানা ধরনের অন্তত ৫ লাখ টন সবজি উৎপাদন হয়। বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির সাবেক পরিচালক কৃষিবিদ ড. এ কে এম জাকারিয়া জানান, সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় প্রকারভেদে উৎপাদিত সবজির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হয়। বাজার দর পড়ে গেলে কখনো কখনো আরও বেশি সবজি নষ্ট হয়।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবর রহমান বলেন, ‘বগুড়ার মহাস্থানহাটকে কেন্দ্র করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষায়িত হিমাগার নির্মাণ করতে হবে। হিমাগার নির্মাণ হলে প্রচুর সবজি সংরক্ষণ করা যাবে। একই সঙ্গে সারা বছর সবজি খাওয়া যাবে এবং চাষিরাও ভালো দাম পাবেন।’
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদার রহমান মিলন জানান, উত্তরাঞ্চলের কেন্দ্রস্থল বগুড়ায় অ্যাগ্রো মেশিনারিজ কারখানার পাশাপাশি ফুড প্রসেসিং ইউনিট ও পাওয়ার প্ল্যান্টসহ আরও অনেক শিল্প-কারখানা স্থাপন করার সুযোগ রয়েছে। তবে তার জন্য প্রয়োজন সেন্ট্রাল ইটিপিসহ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ভালো অবকাঠামো, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি সঠিক উদ্যোক্তাকে প্রয়োজনীয় ব্যাংক লোন নিশ্চিত করা।
মাসুদার রহমান মিলন বলেন, ‘সেন্ট্রাল ইটিপি থাকলে এক দিকে যেমন শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠায় ব্যয় কমে তেমনি পরিবেশ রক্ষা সহজ হয়। গত ১০ বছরে বগুড়ায় অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন খাতে। বগুড়ায় এখন ৪টি রাইস ব্র্যান অয়েল মিল থাকলেও আরও প্রয়োজন এবং সেগুলো প্রতিষ্ঠার সুযোগ আছে। আজাদ গ্রুপ ও বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন লিমিটেড (বিসিএল) পরিচালনা করছে অন্তত ২২টি শিল্প-কারখানা। এসবের মধ্যে আছে সিরামিক, গ্লাস ও বোর্ডমিলসহ নানা ধরনের শিল্প-কারখানা।’
এস আর গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান উত্তরাঞ্চলে একমাত্র এস আর কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড উৎপাদিত অধিকাংশ রাসায়নিক দ্রব্য রপ্তানি হয় চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, জাপান, মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কায়। ১ হাজার কোটি টাকার প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কাঁচামাল বিদ্যুৎ। সে কারণেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রয়োজন এ শিল্পে। প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আসিফ রব্বানী বলেন, ‘সরকারি সহযোগিতা পেলে এ কারখানায় উৎপাদিত পণ্য আরও অনেক দেশেই রপ্তানি সম্ভব।’
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু জানান, বিশেষায়িত হিমাগার, মিঠা পানির মাছ ও পান প্রসেসিং ইউনিটসহ নানা ধরনের শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে রাজশাহীতে। কিন্তু উদ্যোক্তারা আসতে চান না অর্থনৈতিক জোন এবং প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে।
রিংকু বলেন, ‘রাজশাহীতে উৎপাদিত মিঠা পানির মাছের চাহিদা রয়েছে ভারতের দার্জিলিং ও শিলিগুড়িসহ পাহাড়ি এলাকায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর ও নওগাঁয় প্রতি বছর যে পরিমাণ আম নষ্ট হয় তা সংরক্ষণে নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষায়িত হিমাগার। টমেটো, মাছ, পান ও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যের ওপর নির্ভর করে নানা ধরনের শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘নানা সমস্যার কারণে বিনিয়োগকারীরা রাজশাহীমুখী হচ্ছেন না। গত ১০ বছরে মাত্র দুটি বড় শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরেকটি শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
একসময় রংপুর অঞ্চলে শিল্প বলতে বিড়ি কারখানাকে বোঝানো হতো। কিন্তু এখন গ্যাস আসার পর অনেকেই শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা কিনছেন। রংপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. আকবর আলী জানান, গত ১০ বছরে হিমাগার ছাড়া তেমন কোনো শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠেনি। একসময় লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও রংপুরে পাটের ব্যবসার কিছুটা প্রসার ঘটলেও পাটভিত্তিক তেমন শিল্প-কারখানা নেই। দুটি জুট মিল রয়েছে।
তিনি আরও জানান, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা ও লালমনিরহাটে বুড়িমারি স্থলবন্দরসহ বেশ কয়েকটি বন্দর আছে রংপুর বিভাগে। নেপাল, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এসব বন্দর এখন ব্যবহার করা হয়। বন্দরসংলগ্ন এলাকাগুলোয় গড়ে তোলা সম্ভব বালি ও পাথরনির্ভর শিল্প-কারখানা। তবে রংপুরে অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
মো. আকবর আলী বলেন, ‘রংপুর অঞ্চলে গ্যাস আসার ফলে শিল্পের বিকাশের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা বাস্তবে কাজে লাগাতে প্রয়োজন অর্থনৈতিক জোনসহ অবকাঠামোর উন্নয়ন।’