
বগুড়ার দইয়ের সুনাম দেশজুড়ে। এ ছাড়া বিদেশে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। এ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘স্বাভাবিক তাপমাত্রায় দই ভালো থাকে দুই থেকে তিন দিন পর্যন্ত। তবে ফ্রিজে রাখলে খাদ্যমান ও স্বাদ ঠিক থাকে প্রায় এক সপ্তাহ। কখনো কখনো আরও বেশি।’
বগুড়ার ১১২ বছরের পুরোনো আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। এ প্রতিষ্ঠানের তৈরি লাচ্ছা সেমাই, চিকন সেমাই আর সাধারণ মিষ্টির মতোই জনপ্রিয় সাদা দই, টক দই, মিষ্টি দই আর ক্ষীরশা। সারা দেশে যেমন চাহিদা রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের দইয়ের তেমন যুক্তরাষ্ট্রেও প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
আকবরিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. হাসেন আলী আলাল জানান, গত কয়েক বছরে তার প্রতিষ্ঠানে তৈরি দই আমেরিকায় গেছে অন্তত ৭ বার। পরীক্ষামূলকভাবে প্রায় ৪০ হাজার শরা দই গেছে আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে। প্রতিটি এলাকা থেকেই দই আবারও পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি বিধিবিধান আর খাদ্যমান ঠিক রাখার পদ্ধতির অভাবে তা সম্ভব হয়নি।
মো. হাসেন আলী আলাল বলেন, ‘এ ধরনের পণ্য রপ্তানিতে সরকারি প্রণোদনার দরকার, প্রয়োজন ভ্যাট-ট্যাক্সে ছাড় ও সেই সঙ্গে প্রয়োজন দীর্ঘক্ষণ সংরক্ষণ নিশ্চিত করা। আগে যেখানে দই তৈরিতে সময় লাগতো ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা সেখানে নতুন কিছু মেশিন বসানোর ফলে এখন সময় লাগে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। নতুন পদ্ধতিতে বানানো দইয়ের খাদ্যমানও ঠিক থাকে আগের চেয়ে বেশি সময়।’
তিনি আরও বলেন, ‘মালয়েশিয়া, নেপাল, কানাডা ও সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারীদের অনেকেই বগুড়ার দই নিয়ে যাওয়ার পর জানতে চেয়েছেন তাদের দেশে পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা আছে কি না।’
বগুড়ার আরেক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান এশিয়া সুইট। ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রথম দই বিক্রি শুরু করে। প্রথমে দিন ৫ মণ দুধে তৈরি করত ১৫০ শরা দই, এখন প্রতিদিন অন্তত ১০০ মণ দুধের দই বানায় প্রতিষ্ঠানটি। এশিয়া সুইটের ম্যানেজিং পার্টনার মো. নুরুল আলম টুটুল এসব তথ্য দিয়ে জানান, ১৯৮৬ সালের আগস্টে প্রতিষ্ঠানটি চালু হয়। বর্তমানে দই মিষ্টির জন্য প্রতিষ্ঠানটির দেশজুড়ে সুনাম আছে।
চিনিপাতা দই নামের দোকানটি বগুড়া শহরে বেশ জনপ্রিয়। শহরের সাতমাথায় দইয়ের এ দোকান থেকে প্রতিদিন বিক্রি হয় গড়ে সাড়ে ৭ মণ দুধের তৈরি প্রায় ১৫০ শরা চিনিপাতা দই। ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর এখান থেকে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই দই নিয়েছেন জাপান, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে।
প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. মুক্তার আলম জানান, মূলত দুধ আর চিনির মানের ওপর নির্ভর করে এ খাবারের মান। তিনি বলেন, যারা এখান থেকে দই নিয়ে বিদেশ গেছেন তাদের অনেকেই প্রশংসা করেছেন। মো. মুক্তার আলম বলেন, ‘বগুড়ায় প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৩০ টন দই তৈরি হয়, যা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। তবে ছুটির দিনগুলোতে আরও অন্তত ১০ টন দইয়ের চাহিদা বেড়ে যায়। উৎসবের দিনগুলোতে এ চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়।’
অনেক বছর ধরেই পাইকারি দই বিক্রি করেন শেরপুর উপজেলার ঘোষপাড়া এলাকার নিমাই ঘোষ। তিনি দাবি করেন, ঘেটু ঘোষের হাত ধরেই তাদের পূর্ব পুরুষরা দই তৈরি শুরু করেন শেরপুরে। শুধুমাত্র বগুড়ার শেরপুরেই দই তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন ৫৬টি পরিবার। এসব পরিবারে দই তৈরিকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ২৫০ জনের।
বগুড়ার প্রতিটি বাসস্ট্যান্ডে দইয়ের দোকান রয়েছে। সেসব দোকানে টক, সাদা, মিষ্টি আর কড়া মিষ্টির ক্ষীরশা পাওয়া যায়। প্রতিটি এলাকা থেকেই দই আবারও পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি বিধিবিধান আর খাদ্যমান সঠিক রাখার পদ্ধতির অভাবে তা সম্ভব হয়নি।
এদিকে বগুড়ার সুস্বাদু এ খাবার ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি পেয়েছে চলতি বছরের জুন মাসে। বগুড়ার সাবেক ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মাদ নূরে আলম সিদ্দিকীর সহযোগিতায় বগুড়ার বিখ্যাত এ খাদ্যের আন্তর্জাতিক সনদ অর্জনে একসঙ্গে কাজ করেছে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি।
বগুড়ার দই কবে কোথায় এবং কে প্রথম তৈরি করেছেন, এ তথ্য সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। অনেকেই মনে করেন, অন্তত আড়াইশ বছর আগে বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় ঘোষ পরিবারের সদস্য ঘেটু ঘোষ প্রথম দই তৈরি করেন। আবার অনেকেই মনে করেন, বহু বছর আগে বগুড়ার নবাব পরিবার তাদের অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য খাদ্য তালিকায় দই যুক্ত করেন।
সময়ের ব্যবধানে টক দইয়ের পাশাপাশি শুরু হয় মিষ্টি দই তৈরি। এখন বগুড়ার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৪০০ দোকানে একই সঙ্গে বিক্রি হয় টক ও মিষ্টি দইয়ের পাশাপাশি ক্ষীরশা। কালের বিবর্তনে দইয়ের স্বাদে বৈচিত্র্য এসেছে। দেশ-বিদেশে বেড়েছে চাহিদা।
এদিকে রপ্তানি আইন শিথিল করার পাশাপাশি খাদ্যমান ঠিক রাখার সময় বাড়ানো গেলে বগুড়ায় তৈরি সুস্বাদু দই রপ্তানি করা যাবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, নেপাল ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।