শেরপুরে বন বিভাগের এক রেঞ্জ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সামাজিক বনায়নের কাঠ বিক্রির সাড়ে ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় বন বিভাগের করা লিখিত অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বন কর্মকর্তার এই দুর্নীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। লট কেনার সময় তারা রেঞ্জ কর্মকর্তার দেওয়া সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে টাকা দিয়েছেন। কিন্তু পরে জানতে পারেন সে টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়নি! বন বিভাগ এখন তাদের ওই টাকা পরিশোধের জন্য চিঠি দিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণে বন বিভাগের উপকারভোগীসহ ব্যবসায়ীরা মানববন্ধন করেছেন।
শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুরি রেঞ্জের সাবেক রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম। ২০১৮ সালে তিনি বিট কর্মকর্তা হিসেবে ওই রেঞ্জে যোগদান করেন। পরে পদোন্নতি পান। শুরু থেকেই তার বিরুদ্ধে সামাজিক বনায়নের গাছ বিক্রিতে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে। বন আইন অনুযায়ী, গাছ বিক্রির টাকা অগ্রিম সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে অনাপত্তিপত্র নিয়ে গাছ কাটতে হয়। আর জমা হওয়া টাকা থেকে ৪৫ ভাগ অংশীদারি জনগণকে চেকের মাধ্যমে দিতে হয়।
জানা গেছে, ব্যবসায়ীরা দরপত্রের মাধ্যমে নিলামে বাগান (লট) কেনেন। পরে বাগানের টাকা রবিউল ইসলামকে দিলে তিনি সাদা কাগজে (কাচা রশিদ) লিখিত দিয়ে বাগান কাটার অনুমতি দেন। এরপর চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি জামালপুরে বদলি হলে প্রকাশ্যে আসে এই গড়মিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বালিজুরি রেঞ্জের আওতায় বালিজুরি সদর, ডুমুরতলা ও কর্ণজোড়া বিটের ২২৯টি উডলট বাগানের ৯ কোটি ৩১ লাখ ৮৭ হাজার ৭৯৫ টাকা অভিযুক্ত রবিউল ইসলাম সরকারি কোষাগারে জমা দেননি।
বনের উপকারভোগীরা জানান, গাছগুলোকে তারা সন্তানের মতো করে বড় করেছেন। নিয়মিত পানি দিয়েছেন, পরিচর্যা করেছেন। কিন্তু সেই সন্তানতুল্য গাছগুলো বিক্রি করা হলেও তাদের কোনো টাকা দেওয়া হয়নি। টাকা চাইলেই আজ না কাল করে ঘোরানো হতো। এভাবেই পার হয়েছে বছরের পর বছর।
কাঠ ব্যবসায়ী জুয়েল আহম্মদ বলেন, ‘আমরা যারা লট কেটেছি তাদের টাকা দিয়েই কাজটি করতে হয়েছে। কারণ লট কাটতে হলে বন বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল ইসলামকে টাকা দিয়ে রশিদ নিয়েছি। পরে জানতে পারলাম ওই টাকা তিনি সরকারি কোষাগারে জমা দেননি। এখন আবার টাকা দিতে চিঠি পাঠিয়েছে বন বিভাগ।’
আরেক ব্যবসায়ী সেলিম মিয়া বলেন, ‘টাকা পরিশোধের জন্য বন বিভাগ থেকে আমাদের চিঠি দিয়েছে। আমি ২০২১ সালে লট কেটেছি। তখন সব টাকা দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন আবার টাকা চাচ্ছে। আমরা এতকিছু বুঝিও না, জানিও না। আমরা আমাদের দাখিল করা পে-অর্ডার ফেরত চাই। একই সঙ্গে রবিউলের বিচার চাই।’
আরেক ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমি ২০১৯ ও ২০ সালের লট কিনি। ওই সময় আমি সব টাকা তার (রবিউল ইসলাম) হাতে বুঝিয়ে দিয়ে একটি কাচা রশিদ (সাদা কাগজে) নিই। এরপর লটগুলো কেটে বিক্রি করি। এখন শুনছি ওই টাকাগুলো ব্যাংকে জমা করে রবিউল নিজেই আত্মসাৎ করেছেন। আমার কথা হলো, উনার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তা হলে কী করলেন? এত অনিয়ম হলো, কেউ দেখল না?’
বালিজুরি রেঞ্জের কাঠ ব্যবসায়ীদের নেতা দুলাল মিয়া বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় দরপত্রের মাধ্যমে উডলট বাগান নিলামে কিনে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই রেঞ্জের প্রায় ২২৯টি লটের টাকা রবিউল ইসলামের কাছে কাঁচা রশিদের মাধ্যমে মৌখিক নির্দেশনায় দেওয়া হয়েছে। এখন শুনছি এই টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া রেঞ্জের উপকারভোগীদের লভ্যাংশও দেওয়া হয়নি। বন বিভাগ টাকা পরিশোধের জন্য মামলা দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।’
অভিযোগের বিষয়ে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও অভিযুক্ত রবিউল ইসলামকে পাওয়া যায়নি। তবে বালিজুরি রেঞ্জের বর্তমান রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমন মিয়া বলেন, ‘এ ঘটনায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। একটা বিভাগীয় পর্যায়ে, আরেকটি প্রধান বন সংরক্ষক দপ্তর থেকে। বিভাগীয় বন কর্মকর্তার তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। আমাকে এ ঘটনায় মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমি শ্রীবরদী থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু বিষয়টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার এখতিয়ার বহির্ভূত হওয়ায় তিনি অভিযোগটি দুদকে পাঠিয়ে দেন। অভিযোগের বিষয়ে দুদকের কার্যক্রম চলমান আছে।’