কিশোর আসিফের মাথায় গুলি লেগেছিল। রক্তে ভিজে গিয়েছিল পরনের লুঙ্গি। তার কবরের কাছে বসে থাকেন মা। লোকজন এলে ছেলের সেই রক্তমাখা লুঙ্গি দেখান আর অঝোরে কাঁদেন।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আসিফের (১৭) বাবা আমজাদ হোসেন বলেন, ‘ঘটনা গত ১৯ জুলাইয়ের। সন্ধ্যা ৬টার দিকে পোলায় ফোন দিয়া বলল, আব্বু আমি অ্যাক্সিডেন্ট করছি, তুমি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আসো। আমি মিরপুর-১০ নম্বরে আলোক হাসপাতালে গিয়া দেখি মাথায় গুলি খাইয়া পোলাডা পড়ে আছে। রক্তে ভিইজ্যা গেছে লুঙ্গি। তখনো গোলচত্বরে গোলাগুলি চলছিল। রাস্তায় রিকশাও তেমন একটা নাই। দু-একটা রিকশা আছিল। গোলাগুলির ভয়ে কেউ যাইতে চাইল না। পরে একটা রিকশা নিয়া সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যাই। ডাক্তার সাহেবরা পোলারে ব্যান্ডেজ করে। নিউরোতে (নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল) নিয়ে যাইতে বলে। এরপর আরেকটা রিকশা কইরা যখন হাসপাতালে যাইতাছি, তখন পোলাডা কইতাছিল, আব্বু আমার ওপর থেকে দাবি ছাইড়া দিও, আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম না। মনে হয়, আমি আর বাঁচব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার বুকটা ফাইট্টা যাইতাছিল। পরে হাসপাতালের নিয়া গেলে ডাক্তার সাহেবরা বলল, আমার ছেলে মইরা গেছে।’
স্বজনদের সূত্রে জানা গেছে, আসিফের বাবা আমজাদ আলী প্রায় ২০ বছর ধরে ঢাকার মিরপুর এলাকায় ঝুট কাপড়ের ব্যবসা করেন। বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের কেরেঙ্গাপাড়া গ্রামে। ছয় সন্তানের মধ্যে আসিফ ছিল দ্বিতীয়। আসিফের বড় বোনের বিয়ে হয়েছে ঢাকায়। অন্য ভাইবোনদের নিয়ে তার মা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। আসিফ প্রায় এক বছর আগে মিরপুরে একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করে। বাবার সঙ্গে মিরপুরে একটি ভাড়া বাসায় থাকত সে। গত ১৯ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছিলেন মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হচ্ছিল। এক বন্ধুর ফোন পেয়ে আসিফ বাসা থেকে বের হয়েছিল। এরপর গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সে।
পরদিন ২০ জুলাই সকালে তার লাশ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। দুপুরে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।
গত বুধবার আসিফের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার মা ফজিলা খাতুন কবরের পাশে বসে আছেন। প্রতিবেশীরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। একপর্যায়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মাটিয়ে গড়াগড়ি করতে থাকেন ফজিলা। একপর্যায়ে মূর্ছা যান। অনেকক্ষণ মাথায় পানি ঢালার পর সংজ্ঞা ফেরে তার।
রক্তমাখা সেই লুঙ্গি দেখিয়ে ফজিলা খাতুন বলেন, ‘আমার পোলাডা রাজনীতি করত না। বড় কোনো চারহিও (চাকরি) করত না। কয়টা ভাতের লাইগ্যা গার্মেন্টসে চারহি করত। আমার কইজার ধনডারে গুলি কইর্যা মাইর্যালছে। যারা তারে মারছে, তাদের বিচার আল্লাহ করব।’
রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. খোরশেদ আলম খোকা বলেন, ‘ঢাকা থেকে আমার ইউনিয়নে একটি লাশ এসেছে। কিন্তু কেমনে মারা গেছে তা জানতে পারিনি। ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা আমি ব্যক্তিগতভাবে তার পরিবারকে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করব।’
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদ রানা বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমি খোঁজখবর নেব। পরিবারটির সহযোগিতায় পাশে থাকব।’