সোমবার বেলা ৩টা। খবর আসে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। তখনই সুনামগঞ্জ পৌর শহরে ছাত্র-জনতা বিজয় মিছিল বের করে। সবাই যখন আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে, তখন বিকেল ৪টার দিকে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর শুরু করে। এ সময় শহরের ডিএস রোডে অবস্থিত জেলার একমাত্র জাদুঘর ঐতিহ্য জাদুঘরে তাণ্ডব চালানো হয়। ভেঙে ফেলা হয় জাদুঘরের সামনের অংশ। এ ছাড়া ভেতরে থাকা কাঠের ফ্রেম ও বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কাঠের ফ্রেমে থাকা বিভিন্ন নিদর্শনও। এই জাদুঘরে ছিল শতবছরের শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এ ঘটনায় জেলার শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সংস্কৃতিকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
সংস্কৃতিকর্মী রিপন চন্দ বলেন, ‘ছাত্রদের এই আন্দোলনে আমাদেরও সমর্থন ছিল। সবার মতো আমিও চেয়েছি তারা তাদের যৌক্তিক দাবি আদায় করুক। কিন্তু সোমবার বিকেলের দিকে কিছু অতি উৎসাহী বিক্ষুব্ধ মানুষ সুনামগঞ্জের সরকারি স্থাপনা ও জেলার শিল্প-সংস্কৃতির তীর্থস্থান ঐতিহ্য জাদুঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। সুনামগঞ্জে আমরা সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করি। আমাদের অসাম্প্রদায়িকতার সুনাম রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি সবাইকে দোষারোপ করব না। কারণ অনেক রাজনৈতিক সংগঠনকে দেখেছি জেলার সরকারি স্থাপনা থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নিজ দায়িত্বে রক্ষা করছেন। কিন্তু কিছু লোক জাদুঘরে হামলা চালিয়ে সুনামগঞ্জকে কলঙ্কিত করেছে। আমরা চাই সবাই মিলে একসঙ্গে সুন্দরভাবে বসবাস করতে।’
ঐতিহ্য জাদুঘরে হামলা ও ভাঙচুরের ব্যাপারে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সুনামগঞ্জের সদস্য খলিল রহমান বলেন, ‘ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের কারণে বর্তমান সময়ে সফলতা এসেছে। এটা তারা উদযাপন করুক, কিন্তু রাষ্ট্রের এবং জনগণের সম্পত্তি ক্ষতি করবে এটা মানা যায় না। সরকারি প্রতিষ্ঠান, জাদুঘর এগুলো আমাদের সম্পদ। এই সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। কিন্তু দুঃখের বিষয় কিছু বিক্ষুব্ধ জনতা আমাদের সুনামগঞ্জের একমাত্র জাদুঘরে হামলা চালিয়ে ক্ষতি করেছে। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ক্ষতি করেছে। এটা দুঃখজনক।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন, সরকারি স্থাপনা রক্ষায় তারা দলের কর্মীদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তার পরও কিছু অতি উৎসাহী মানুষ এই জাদুঘরে হামলা চালিয়েছে।’
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন নিদর্শন এখানে সাজানো ছিল। বাংলাদেশের রাজনীতি, জাতীয় চার নেতা, সাত বীরশ্রেষ্ঠ, ভাষাশহিদদের জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে এখানে বিস্তর তথ্য ছিল। সংস্কৃতি বিভাগে ছিল জেলার মরমি সাধকদের আলোকচিত্র, তাদের গানের পাণ্ডুলিপি, ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদসহ নানা সামগ্রী। এ ছাড়া সুনামগঞ্জের রূপ-সৌন্দর্যের বেশ কিছু আলোকচিত্র ও মানুষের ব্যবহৃত পুরোনো তৈজসপত্র ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশ বিভাগে। জীবন-জীবিকা বিভাগে হাওরে মাছ ধরা ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত বাহারি যন্ত্র সংরক্ষণ করা। এসব এখন হাওর এলাকা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে হাওরের মিঠা পানির ৩৬ প্রজাতির মাছ ছোট-বড় বয়ামে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা ছিল।
বর্তমানের জাদুঘরটি একসময় জেলা কালেক্টরেট ভবন ছিল। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় শহরের অন্যত্র স্থানান্তর হলে একসময় ভবনটি অযত্ন-অবহেলায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। পরে ২০১৪ সালে ভবন সংস্কারের কাজ শুরু হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি।