ঝরে পড়া বা কখনই স্কুলে ভর্তি হয়নি এমন শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতে পটুয়াখালীতে কাজ করছে পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (পিডিও) নামে একটি সংগঠন। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন’ শিক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে সংগঠনটি তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। এই কর্মসূচির আওতায় জেলায় ১৬ হাজার ৮০০ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। কিন্তু তাদের শিক্ষায় নিয়োজিত ৬ শতাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তা-সুপারভাইজার গত ৮ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না! ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো থেকে এ প্রোগ্রামের জন্য কোনো অর্থ ছাড় দেওয়া হয়নি। এতে তাদেরকে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকে মানসিক ও আর্থিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থছাড় হলে এ সংকট কেটে যাবে।
পিডিও কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, পটুয়াখালী জেলার আট উপজেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে জরিপের ভিত্তিতে এ জেলায় ৫৬০টি শিখনকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে ১৬ হাজার ৮০০ শিক্ষার্থীকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তারা চতুর্থ শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। চলমান কর্মসূচিতে ৫৬০ জন শিক্ষক, ৪০ জন প্রোগ্রাম সুপারভাইজার, ৮ জন উপজেলা প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ৪ জন জেলা কর্মকর্তা ও ১জন অফিস সহায়ক কর্মরত আছেন।
পিডিও সূত্রে জানা গেছে, কর্মসূচি বাস্তবায়নের কৌশল অনুযায়ী, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো থেকে পাওয়া বরাদ্দ পিডিওর মাধ্যমে ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন’ শিক্ষা কর্মসূচির শিক্ষকদের বেতন, শিখন কেন্দ্রের ভাড়া, প্রোগ্রাম সুপারভাইজার ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সবার বেতন চলমান ছিল। কিন্তু এরপর থেকে আর অর্থছাড় পাওয়া যায়নি। এতে সংশ্লিস্টরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তবে এসব শিখন কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের দেওয়া বিনামূল্যের বই, পেনসিল, খাতা, চক, ডাস্টার, স্কুল ব্যাগ, ড্রেস ইত্যাদি সরবরাহ করে পাঠদান অব্যাহত রয়েছে। শিক্ষার্থীরা গ্রেড পরিবর্তন পরীক্ষার মাধ্যমে পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত হচ্ছে।
পিডিওর জেলা কর্মকর্তা (ডেপুটি ম্যানেজার-মনিটরিং) তাইজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাড়ি যশোর। চাকরি সূত্রে পটুয়াখালী থাকি। দীর্ঘ আট মাস ধরে বেতন বন্ধ থাকায় খুব বিপদে আছি। চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। বাইরের জেলার বাসিন্দা হওয়ায় দোকানিরা বাকিও দিচ্ছেন না। থাকা-খাওয়ার খরচ মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পরিবারের জন্য বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছি না।
পটুয়াখালী সদর উপজেলা শিখন কেন্দ্রের শিক্ষক রাহিমা আক্তার হতাশা প্রকাশ করে জানান, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার নিয়ে দোকান বাকি করে কোনোমতে জীবন কাটাচ্ছেন। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে সংস্থাটির দুমকি উপজেলা প্রোগ্রাম ম্যানেজার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘৮ মাস ধরে বেতন বন্ধ। সংসার চালাতে পারছি না। সব শিক্ষক-সুপারভাইজারদের অবস্থা আমার মতোই করুন। দ্রুত সময়ের মধ্যে বেতনের টাকা না পেলে আমরা বড় সংকটের মধ্যে পড়ব।’
মির্জাগঞ্জের শিক্ষক রুবিনা আক্তার বলেন, ‘আমি মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়েছি। পিডিওর কাছে জানতে চেয়েছিলাম কবে নাগাদ বেতন পাব- তার একটা নির্দিষ্ট টাইমলাইন দিতে। আমরা তো চাকরি করি। অনেক সময় চক্ষুলজ্জার কারণে অনেক কিছু বলতে পারি না। উপজেলা সুপারভাইজারদের সঙ্গে আলোচনা করে যাচ্ছি।’
কলাপাড়া উপজেলার প্রোগ্রাম সুপারভাইজার তানিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার দায়িত্বে ১৪টি শিখনকেন্দ্র রয়েছে। ওই কেন্দ্রগুলোর সব শিক্ষকের একই অবস্থা। তারা নিয়মিত ক্লাস নেন, কিন্তু বেতন পান না। সবাই মানবেতর জীবন যাপন করছেন।’
পিডিওর নির্বাহী পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাথমিকে শতভাগ শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনতে হলে আমাদের এই কর্মসূচির শতভাগ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে অর্থছাড় করতে হবে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে হলে এই প্রকল্প ২০২৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখতে হবে।’
পটুয়াখালী জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক (অঃ দাঃ) মফিজুল ইসলাম বলেন, অর্থ প্রাপ্তিতে দেরি হচ্ছে, ঘটনা সত্য। তবে নির্দেশিকা অনুযায়ী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অর্থছাড় হলে মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে মনে করেন তিনি।