বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে গত ৪ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সিরাজগঞ্জ শহরে ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী লীগের হামলা ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পুরো শহর। এতে এসএস রোড ও মুজিব সড়কে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। উভয় পক্ষ ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে শহর যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রঞ্জু মিয়া (৪০), পৌর শহরের গয়লা মহল্লার আসু মুন্সীর ছেলে আব্দুল লতিফ (২৬) ও একই মহল্লার গঞ্জের আলীর ছেলে সুমন সেখের (২২) মৃত্যু হয়।
নেতা-কর্মীদের মৃত্যুর খবরে বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরীর বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে আন্দোলনকারীরা দখলে নেয় পুরো শহর। সিরাজগঞ্জ সদর ভূমি অফিসে ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে ভূমি অফিসের প্রতিটি কক্ষে আগুন ধরে যায়। পুড়ে ছাই হয়ে যায় বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান নথি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। পাশাপাশি জেলা শিল্পকলা একাডেমি, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ ফাঁড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে করে সদর ভূমি অফিসে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়।
সরেজমিনে সদর উপজেলা ভূমি অফিসে দেখা যায়, তাণ্ডবে সদর উপজেলার ভূমি অফিসটি প্রায় পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। অগ্নিসংযোগের পর থেকে সকল পর্যায়ের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সহকারী কমিশনার ভূমি এস এম রকিবুল হাসান অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন কর্মচারীরা। সেবাগ্রহীতা কেউ এলে তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ফেরত পাঠাচ্ছেন। এতে করে ভূমিসংক্রান্ত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা সাধারণ মানুষ।
কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, ‘হামলার দৃশ্য নিজ চোখে না দেখলে বুঝাতে পারা যাবে না। সেই দিনের নৃশংসতার দৃশ্য নিজ চোখে দেখেছি। হামলাকারীরা ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালায়। আমাদের রুমের বাইরে বের করে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকা। এতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় অফিস ও গ্রাহকদের সকল মূল্যবান নথি। আমরাও ভয়ে সেখান থেকে দূরে সরে যাই।’
সেবা নিতে আসা সদর উপজেলার বাসিন্দা আব্দুর রহমান জানান, ৪০ শতাংশ জমির দলিলসহ অন্য কাগজপত্র ছিল উপজেলা ভূমি অফিসে। এ মাসেই জমি বিক্রি করার কথা ছিল। কিন্তু তার কাগজপত্র সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন কাগজপত্র না পেলে আর জমি বিক্রি করতে পারবেন না তিনি।
সদর উপজেলার বিরালাকুটির এলাকার বাসিন্দা আয়শা খাতুন সদর ভূমি অফিসে সেবা নিতে এসে বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর ধরে একটি জমির জন্য অনেক লড়াই করে আসছি। কাজও প্রায় শেষের দিকে। সামনে একটা শুনানির তারিখ ছিল। কিন্তু হঠাৎ দুর্বৃত্তদের দেওয়া অগ্নিসংযোগে পুরো ভূমি অফিস পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমরা আবার পিছিয়ে গেলাম। আগামী সপ্তাহে আসতে বলছে সহকারী ভূমি কর্মকর্তা।
ভূমি অফিসে কাগজপত্র ঠিক করতে আসা রহিম সেখ, আলাল হোসেন, মোক্তার হোসেন, সোরমান আলীসহ আরও অনেক মানুষকে ভূমি অফিসে এসে সেবা না নিয়েই ফিরে যেতে দেখা গেছে। এ সময় তারা বলেন, সদর ভূমি অফিসে বসার মতো জায়গা নেই। মেরামতের কাজ চলছে।
এ বিষয়ে সদর সহকারী কমিশনার ভূমি এস এম রকিবুল হাসান খবরের কাগজকে বলেন, গত ৪ আগস্ট হঠাৎ করে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। আগুনে ভূমি অফিসের প্রতিটি কক্ষ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কত মানুষের ভূমির রেকর্ডপত্র পুড়ে গেছে, তার সঠিক হিসাব নেই। পুড়ে যাওয়া কক্ষগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি কক্ষে মূল্যবান দলিল ও রেকর্ডপত্র ছিল। আগুনে এমন কিছু নথিপত্র পুড়েছে, যা পূরণ হওয়ার নয়। কীভাবে এসব নথিপত্র উদ্ধার করা হবে, তাও জানা নেই। কাগজপত্রগুলো পুড়ে যাওয়ায় মারাত্মক সমস্যায় পড়বেন সাধারণ মানুষ।