একসময় ঠাকুরগাঁও জেলার বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদ-নদীগুলো ছিল প্রাণচাঞ্চল্যের প্রতীক। লঞ্চ, ট্রলার আর মাছ ধরার নৌকার কোলাহলে মুখরিত এসব নদী এখন শুধুই স্মৃতি। গত ৫০ বছরে অন্তত ১৩টি নদ-নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। সম্প্রতি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এক অনুসন্ধানে এই হারিয়ে যাওয়া নদীগুলোর অস্তিত্বের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
ঠাকুরগাঁও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গোলাম যাকারিয়া জানান, বর্তমানে জেলার চিহ্নিত নদীর সংখ্যা মাত্র ১৪টি। নতুন করে পাওয়া ১৩টি নদীর তথ্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘যদি প্রকল্প অনুমোদন হয়, তবে নদীগুলো দখলমুক্ত করে পুনঃখনন করা হবে।’
জেলার বিভিন্ন এলাকায় হারিয়ে যাওয়া নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে- রশিয়া, হাতুরি, জলই, পুনর্ভবা, মরা গোগরা, চাড়াল বান্দ, নহনা, আমান-ধামান, কাহালাই, বাগমারা, সারডুবি, মরাটাঙ্গন ও ভক্তি নদ। অধিকাংশ নদী শুকিয়ে ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে, কোথাও আবার সংকীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে।
সদর উপজেলার ভেলাজান এলাকার প্রবীণ শিক্ষক রফিকুল ইসলাম (৬৫) বলেন, ‘ছোটবেলায় দেখেছি, এই নদীতে লঞ্চ চলত। এখন শুধু স্মৃতিতে রয়ে গেছে।’
সদর উপজেলার শুখানপুকুরী ও বালিয়া ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সারডুবি নদ এখন প্রায় মৃত। পাউবোর সদর উপজেলার কার্য সহকারী শফিউজ্জামান জানান, এই নদীর ৭০ শতাংশ জমিতে এখন চাষাবাদ হয়, বাকি অংশ সংকীর্ণ খালে রূপ নিয়েছে।
পীরগঞ্জ উপজেলার কাহালাই নদ প্রায় পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। পাউবোর পীরগঞ্জ কার্যালয়ের সহকারী কর্মকর্তা শারাফাত হোসেন বলেন, নদীর ৭৫ শতাংশ জায়গায় চাষাবাদ হচ্ছে।
স্থানীয় কৃষক আব্দুল হামিদ (৫০) বলেন, আগে এই নদীর পানি সেচের জন্য ব্যবহার করা হতো। এখন নদী না থাকায় চাষাবাদেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সৃজন’-এর সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, দখল, দূষণ এবং প্রশাসনিক উদাসীনতার কারণে নদীগুলো বিলীন হয়েছে। অনুসন্ধান করলে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা জানান, কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে ১৩টি নদীর পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একসময় এসব নদী ঠাকুরগাঁওয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। যদি নদীগুলো পুনরুদ্ধার করা যায়, তাহলে শুধু পরিবেশ নয়, মানুষের জীবনও ফিরে পাবে তার হারানো প্রাণচাঞ্চল্য।
নবীন হাসান/মাহফুজ