‘মেয়েটার তিন দিন ধরে শ্বাসকষ্ট ও জ্বর। গত শুক্রবার রাতে হাসপাতালে নিয়ে আসি। কিন্তু শিশু ওয়ার্ডে এত রোগী, বেড পাওয়া তো দূরের কথা, একটু বসার জায়গাও পাইনি। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে সারা রাত দাঁড়িয়ে ছিলাম। রাতে কোনো ডাক্তার ছিলেন না। সকালে একজন ডাক্তার এসেছিলেন, বললেন নিউমোনিয়া। গ্যাস (নেবুলাইজার) দিতে হবে। কিন্তু হাসপাতালে দাঁড়ানোরও সুযোগ পাচ্ছি না। হাসপাতালের মেঝে-বারান্দাও অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্ন। এমন অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকলে মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমিও অসুস্থ হয়ে যাব।’
ভোলা সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের দুর্ভোগের কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন শাবনুর। তিনি সদর উপজেলার শিবপুর শান্তির হাট স্লুইস গেট এলাকা থেকে মেয়ের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছেন। তবে শুধু শাবনুর নন, সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিতে আসা প্রায় রোগীর অভিভাবকেরই একই অভিযোগ।
ভোলা সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের শয্যা সংখ্যা ৪০টি। অথচ প্রতিদিন গড়ে শয্যা সংখ্যার দ্বিগুণ রোগী ভর্তি হচ্ছেন। ফলে এক বেডে ৩ থেকে ৪ জন রোগীকে রাখতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে অপরিচ্ছন্ন বারান্দা ও মেঝেতেও চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, শিশু ওয়ার্ডে সিরিঞ্জ, ক্যানোলা, স্যালাইন, সার্জিক্যাল টেপ ও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের পর্যাপ্ত সরবরাহও নেই।
এ ছাড়া হাসপাতালে কোনো একজন শিশু হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে কোনো চিকিৎসককে পাওয়া যায় না। অথচ নিয়ম অনুযায়ী একজন চিকিৎসক ২৪ ঘণ্টা শিশু ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকার কথা। রোগীর সংখ্যানুযায়ী নেই পর্যাপ্ত নার্সও। আড়াই শর বেশি শিশুর চিকিৎসাসেবা দিতে মাত্র চারজন নার্স ও একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োজিত আছেন।
ভ্যাপসা গরমে শিশুরা নিউমোনিয়া, জ্বর, সর্দি-কাশিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে সদর হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে। এত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন। গতকাল শনিবার সদর হাসপাতালে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে শুক্রবার সকাল থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত নতুন করে ৮৩ জন শিশু ভর্তি হয়েছে। গত এক মাসে ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ৬০২ জন। এর মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছে প্রায় ২০০ শিশু। ডায়রিয়া ওয়ার্ডেও আরও শতাধিক রোগী ভর্তি আছে। প্রতিনিয়ত ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলছে। বহির্বিভাগে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ জন রোগী চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন।
হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছে এমন এক রোগীর মা অংকুর রায় বলেন, ‘গত ১ সেপ্টেম্বর নিউমোনিয়া আক্রান্ত ছেলেকে ভর্তি করেছি। প্রথমে বেড না পাওয়ায় বাইরের মেঝেতে থাকতে হয়েছে। শুক্রবার বেড পেয়েছি। শুধু বেড কম তা নয়, শিশু ওয়ার্ডে প্রায় ২৫০ জন রোগীর জন্য মাত্র দুটি নেবুলাইজার রয়েছে, তাও ভাঙা।’
আরেক রোগীর মা মারুফা বেগম বলেন, ‘আমার বাচ্চাকে ঠাণ্ডার কারণে ভর্তি করেছি। কিন্তু বেড খালি না থাকায় অন্য একজনের বেডে থাকতে হচ্ছে। হাসপাতালের পরিবেশও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়। সুস্থ মানুষও এখানে অসুস্থ হয়ে যাবে। তাই সারাক্ষণ বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে।’
দৌলতখান উপজেলার মিয়ার হাট এলাকা থেকে মেয়ে রাইসাকে জ্বর-সর্দি নিয়ে সদর হাসপাতালে আনেন তার বাবা-মা। শিশুটির ঠাঁই হয়েছে শিশু ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে। রাইসার মা বলেন, ‘মেয়েটাকে ভর্তি করানো হলে নার্সরা আমাদের বাইরে থেকে ক্যানোলা, সার্জিক্যাল টেপ ও ইনজেকশন কিনে আনতে বলেন। পরে সেই ক্যানোলা রাইসার হাতে লাগান। কতক্ষণ পরে বলেন আবার ওষুধ কিনে আনতে হবে। সরকারি হাসপাতালেও আমাদের সবকিছু বাইরে থেকে কিনে আনতে হচ্ছে।’
রোগীর অভিভাবকদের দেওয়া বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে শিশু ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স সালমা বেগম বলেন, ‘শনিবার (গতকাল) ২৬০ জন অসুস্থ শিশু ভর্তি হয়েছে। প্রতিদিনই নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে। ওয়ার্ডে চারজন নার্স ডিউটি করছেন। পরিস্থিতি সামলাতে অন্য ওয়ার্ড থেকে আরও পাঁচজন নার্স ডেকে এনেছি। আমাদের জনবল সংকট। তারপরও সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
শিশু ওয়ার্ডের পরিবেশ কিছুটা অপরিচ্ছন্ন। এই বিষয়টি মানলেও ওষুধের সরবরাহ কম মানতে নারাজ হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. তায়েবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে শিশু রোগীদের পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ রয়েছে। পাশাপাশি তাদের চিকিৎসা দেওয়া জন্য বিপুলসংখ্যক মেডিকেল অফিসার ও শিশু বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তবে প্রতিদিনের রোগীর তুলনায় শিশু ওয়ার্ডের শয্যাসংকট রয়েছে। একই স্থানে ধারণক্ষমতার চেয়ে তিন গুণ রোগী অবস্থান করায় শিশু ওয়ার্ড কিছুটা অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্ন থাকছে।’