দুর্বৃত্তদের হামলার শঙ্কায় সুনামগঞ্জের শাহ্ আরেফিন আস্তানায় গান-বাজনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে প্রশাসন। এদিকে সিরাজগঞ্জে মাজার ভাঙচুর করে কবর খুঁড়ে হাড়গোড় তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে মসজিদসহ মাজার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া ঢাকার ধামরাইয়ে বুচাই পাগলার মাজার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন মুসল্লিরা। প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় শাহ্ আরেফিন আস্তানায় গান-বাজনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দুর্বৃত্তরা আস্তানা এলাকায় হামলা করতে পারে, এই আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) আস্তানা এলাকায় এ সংক্রান্ত একটি ব্যানার টাঙিয়েছে আস্তানা পরিচালনা কমিটি।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আস্তানা এলাকায় সব প্রকার গান-বাজনা, মাদক সেবন, সাপ্তাহিক ওরসসহ অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ রাখার অনুরোধ করা হলো। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জনসাধারণের সামনে এলে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তকে অনেকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তবে সংস্কৃতিপ্রেমীরা, আস্তানা এলাকায় মাদকসেবন ও অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধে একমত হলেও গান-বাজনা ও জিকির-আজকার নিষিদ্ধ করার বিষয়টিতে আপত্তি জানিয়েছেন।
শাহ্ আরেফিন আস্তানায় দীর্ঘ ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে গান-বাজনার সঙ্গে জড়িত আছেন বাউল জাকির দেওয়ান। তিনি বলেন, ‘গান-বাজনার মধ্যে অসামাজিক কিছু দেখছি না। এসব আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির অংশ। মনের টানে আমার মতো অনেক ফকির-সন্ন্যাসী-বাউল এখানে গান-বাজনা করতে আসেন। কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে আমরা হতাশ।’
শাহ্ আরেফিন আস্তানা কমিটির সদস্য সচিব আলম সাব্বির বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন মাজার ও আস্তানায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে আস্তানা কর্তৃপক্ষ সতর্কতা অবলম্বনের অংশ হিসেবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার একটি মাজারে হামলা-ভাঙচুর চালানোর পর তিনটি কবর খুঁড়ে সেখান থেকে হাড়গোড়-মাথার খুলি তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়াও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে মাজারের জরুরি কাগজপত্র ও বিভিন্ন সরঞ্জাম। এমনকি মাজারের দানবাক্স ও ট্যাংক ভেঙে টাকা লুট করা হয়েছে। গত সোমবার সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামে ‘হজরত বড়পীর গাউসুল আজম দরবার শরীফে’ এ ঘটনা ঘটে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাইকিং করে এবং এক দল লোক জমায়েত হয়ে এমন তাণ্ডব চালালেও কেউ তাতে বাধা দেয়নি। এমনকি কেউ এগিয়েও আসেনি।
গত বুধবার সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙচুর করা মাজারের তিনটি কবর খোঁড়া রয়েছে। তার ভেতরে থাকা মানুষের হাড়, মাথার খুলি দুর্বৃত্তরা তুলে নিয়ে গেছে। দুইটি খানকা ঘর ও একটি রান্নাঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে মাজারের নানা সরঞ্জাম। এ ঘটনার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত থানায় গিয়ে কেউই এ বিষয়ে অভিযোগ করেননি বলে জানিয়েছে সদর থানার ওসি হুমায়ুন কবির।
এ বিষয়ে মাজারের খাদেম শিলন্দা গ্রামের হাফিজুল ইসলাম বলেন, গত সোমবার সকালে শিয়ালকোল বাজারে এক দল দুর্বৃত্ত একত্রিত হয়ে মাজার ভাঙচুরের ঘোষণা দেয়। ঘোষণা দেওয়ার কিছুক্ষণ পর তারা মিছিল নিয়ে মাজারে তাণ্ডব চালায়। হামলাকারীরা শাবল, হ্যামার, দুরমুজ, লোহার রড ও লাঠিসোঁটা দিয়ে মাজারের বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করেন। কবর ভেঙে ভেতরে থাকা দেহাবশেষ বস্তায় ভরে নিয়ে যায় তারা। এ সময় চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হামলাকারীরা মাজারে আগত লোকজনকে ছবি তুলতে ও ভিডিও করতে নিষেধ করেন।
মাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক হজরত আলী বলেন, ‘২০ বছর ধরে এখানে মাজারের কার্যক্রম চললেও কেউ কোনো দিন বাধা দেয়নি। অথচ এখন প্রকাশ্যে মাজারে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। আমরা এ ঘটনার বিচার চাই। বেঁচে থাকার স্বাধীনতা চাই।’
এ বিষয়ে ওসি হুমায়ুন কবির খবরের কাগজকে বলেন, ‘মাজার ভাঙচুরের কথা শুনেছি। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউই থানায় এসে অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ): নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচল উপশহরের ১১ নম্বর সেক্টরে ৮০ বছরের পুরোনো মসজিদসহ লেংটার মাজারে হামলা চালিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ওই সময় মসজিদ ও মাজারের ভবন ভেকু মেশিনের সাহায্যে ভেঙে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে হামলাকারীরা আগুন দিয়ে মাজারের বহু চিহ্ন পুড়িয়ে মুছে ফেলে। গত মঙ্গলবার রাত ১২টার পর মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে এ হামলা চালানো হয়।
মাজারের খাদেম জাকির হোসেন জানান, প্রায় একশত বছর আগে পূর্বাচলের ১১ নম্বর সেক্টরে হজরত হোসেন আলী শাহ্ আস্তানা করেন। ১৯৬২ সালে তিনি মারা গেলে ওই জায়গায় লাশ দাফন করে মাজার হিসেবে গড়ে তোলা হয়। জীবদ্দশায় হজরত হোসেন আলী শাহ্ উলঙ্গ থাকার কারণে খাদেমরা লেংটার মাজার বলে সাইনবোর্ড দেন।
এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ থানার ওসি লিয়াকত আলী বলেন, মঙ্গলবার রাতে কয়েক শতাধিক দুর্বৃত্ত মাজারে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। এ সময় মাজারের পাশে থাকা মসজিদে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত রূপগঞ্জ থানায় কেউ কোনো অভিযোগ করেনি।
ধামরাই (ঢাকা): ঢাকার ধামরাইয়ে প্রায় সহস্রাধিক মুসল্লি মিলে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন বাবা বুচাই চান পাগলার মাজার। মাজার ভাঙার খবর ছড়িয়ে পড়ায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রশান্ত বৈদ্য ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছালে মুসল্লিদের সঙ্গে তাদের সমঝোতা হয়। গত বুধবার দুপুরের দিকে উপজেলার সানোড়া ইউনিয়নের বাটুলিয়া গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। জানা যায়, বুচাই চান পাগলার মাজারটি ভাঙতে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজারও মুসল্লি, বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে আসা ছাত্র অংশ নেন।
উপজেলার সানোড়া ইউনিয়নের বাটুলিয়া এলাকার বুচাই চান পাগল বা লেংটা পাগল নামে ডাকা হতো। বুচাই পাগল ২০০০ সালে মারা যান। পরে তাকে কালামপুর বালিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে সানোড়া ইউনিয়নের বাটুলিয়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। পরে স্থানীয় লোকজন বুচাই পাগলার কবরটি বাঁধাই করে দেন। ধীরে ধীরে সেখানে বুচাই চান পাগলার কবরটি মাজার হিসেবে গড়ে তুলেন। স্থানীয় লোকজন মাজারকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর মাসব্যাপী মেলা ও ওরস পালন করেন।
মাজার ভাঙতে আসা মুসল্লিরা জানান, মাজারে মাদকসেবনসহ নানা ধরনের অসাজিক কার্যকলাপ চলে। মাজারে সিজদা করা হয়। নারী-পুরুষ একে অপরকে ধরে আলিঙ্গন করে। শুধু বুচাই পাগলার মাজারে নয়, মাজার কমিটির লোকজনকে পায়ে পরে সিজদা করে, যা সম্পূর্ণ হারাম, শিরক (মহাপাপ)। তাই দীর্ঘ দিন ধরেই মাজারটি বন্ধ করার জন্য মুসল্লিরা বলে এলেও কোনো কাজ হয়নি।