হবিগঞ্জের মাধবপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সেই সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠেছে মানবপাচারকারী চক্র। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু মানুষ এই সীমান্ত দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশের সময় বিজিবির হাতে আটক হয়েছেন। মাধবপুর সীমান্ত হয়ে ভারতে অনুপ্রবেশের প্রবণতা এখন সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। স্থানীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সম্প্রতি সীমান্ত এলাকায় রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রভাবশালীদের আনাগোনাও বেড়েছে।
বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বলছে, অনুপ্রবেশ বেড়ে যাওয়ায় সীমান্তে জনবল দ্বিগুণ করা হয়েছে। নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া মানবপাচারকারীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হবিগঞ্জ জেলার সঙ্গে ভারতের প্রায় ৬০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। চুনারুঘাট, মাধবপুর ও বাহুবল উপজেলার এই সীমান্ত এলাকাটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশিদের জন্য শিক্ষা ও জরুরি চিকিৎসা ছাড়া সব ধরনের ভিসা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রেখেছে ভারত। এ সিদ্ধান্ত হওয়ার পর থেকেই হবিগঞ্জের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশের মাত্রা বেড়েছে। এর মধ্যে সহজ পথ হিসেবে ভারতে গমনেচ্ছুরা মাধবপুর সীমান্ত এলাকাকে বেছে নিচ্ছেন।
মাধবপুর উপজেলার ধর্মঘর, আন্দিউরা ও তেলিয়াপাড়া সীমান্ত ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর থেকেই ওই এলাকায় অপরিচিত মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন নেতা-কর্মী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও প্রায় সময় ওই এলাকায় দেখা যাচ্ছে।
মাধবপুর সীমান্তের নিরাপত্তা ও টহল কার্যক্রম পরিচালনা করে সরাইল বিজিবি ব্যাটালিয়ন। তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে অনুপ্রবেশের সময় ২৫ জনের বেশি ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে। তেলিয়াপাড়া সীমান্ত এলাকার এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ইদানীং সীমান্ত এলাকায় অপরিচিত মানুষের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। তারা অল্প সময়ের মধ্যে এখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যান।’
এদিকে গত ১ সেপ্টেম্বর মাধবপুরের সুরমা সীমান্ত এলাকা থেকে একটি বিলাসবহুল গাড়িসহ দুজনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে জানা যায়, গাড়িটি কুমিল্লার সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাহসিন বাহার সূচনার দেবর রুবেল মিয়ায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রুবেল মিয়া কুমিল্লার মানুষ হলেও মাধবপুরে তার বাড়ি রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয়দের মধ্যে রুবেল মিয়ার এ পথ দিয়ে ভারতে চলে যাওয়ায় আলোচনা রয়েছে।
সক্রিয় মানবপাচার চক্র
ভারতে অনুপ্রবেশে মানুষের আগ্রহকে পুঁজি করে সীমান্ত এলাকায় বেশ কয়েকটি মানবপাচারকারী চক্র সক্রিয় হয়েছে। চক্রগুলো সীমান্ত পাড়ি দিতে ইচ্ছুক মানুষদের চুক্তির ভিত্তিতে সীমান্ত পাড় করে দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চক্রের এক সদস্য জানান, সীমান্ত পাড় করা হয় বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে। ভারতে যাওয়ার কারণ এবং আর্থিক সামর্থ্যের ওপর এটি নির্ভর করে। যেমন কেউ যদি কাজের জন্য যায় তা হলে এক রেট, ঘুরতে গেলে এক রেট, আবার পরিবার-পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে যেতে চাইলে এক রেট। সেটি জনপ্রতি তিন থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করে।
মানবপাচারের হাতিয়ার শিশু
সরাইল ২৫ বিজিবি ব্যাটালিনের অধিনায়ক লে. কর্নেল ফারাহ মোহাম্মদ ইমতিয়াজ বলেন, ‘পাচারকারীরা পাচারের ধরন পাল্টেছে। বিশেষ করে তারা এখন শিশুদের ব্যবহার করছে। তারা মনে করে শিশু সঙ্গে থাকলে আটক করা হবে না। তাই যাদের পাচার করা হয় তাদের সঙ্গে এক বা একাধিক শিশু রাখার চেষ্টা করে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মাধবপুর সীমান্ত থেকে যাদের আটক করেছি তাদের মাধবপুর থানায় হস্তান্তর করেছি। পরে দেখা যায় থানায় কিছু লোক গিয়ে বলেন, শিশুদের অপরাধ কী। ওদের ছেড়ে দেন। বিভিন্ন কথা বলে আটকদের ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।’
টহল জোরদার-তালিকা তৈরি
মাধবপুরের ধর্মঘর, তেলিয়াপাড়া, আন্দিউড়া ও হরষপুর সীমান্তে টহল জোরদার করেছে ২৫ বিজিবি ব্যাটালিয়ন (সরাইল)। একই সঙ্গে ওই এলাকায় সক্রিয় থাকা পাচারকারী চক্রের একটি তালিকাও তারা তৈরি করেছে।
২৫ বিজিবি ব্যাটালিনের অধিনায়ক লে. কর্নেল ফারাহ মোহাম্মদ ইমতিয়াজ বলেন, ‘বিজিবিতে জনবলসংকট রয়েছে। তবু যেহেতু অবৈধ অনুপ্রবেশ বেড়েছে তাই সীমান্তে আগের চেয়ে দ্বিগুণ জনবল বাড়ানো হয়েছে। তারা সব সময় সীমান্তে কড়া নজর রাখছেন।’
নরসিংদী ও গাজীপুরের মানুষ মাধবপুর সীমান্তকে ব্যবহার করে ভারতে অনুপ্রবেশ করতে চায় জানিয়ে বিজিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এরই মধ্যে মানবপাচারে সক্রিয় দালালদের একটি তালিকা আমরা তৈরি করেছি। এই তালিকাতে মাধবপুরের ৯ জন আছেন। তাদের মধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছি। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান আছে।’