মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত ৩০০ বছরের বেশি বয়সের কাঠবাদাম গাছটি ঝড়ে উপড়ে পড়েছে। প্রতি বছর সাগরদাঁড়িতে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মধুমেলাসহ বিভিন্ন সময় আসা পর্যটকরা ওই গাছটির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলাসহ মহাকবিকে স্মরণ করতেন। ছোটবেলায় এই বাদামগাছের তলায় বসে মহাকবি অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। এমনকি কাঠবাদাম গাছটির নিচে ১৪ দিন তাঁবু টানিয়ে তিনি বসবাসও করেছেন।
যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ির কপোতাক্ষ নদের পাড়ে এই কাঠবাদাম গাছটি ছিল। কয়েক দিনের টানা ভারী বর্ষণে রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) আকস্মিক ঝড়ে গাছটি নদের পাশে সড়কে উপড়ে পড়ে। গাছটি পড়ে যাওয়ার খবরে এলাকার মধুভক্তরা সেটি দেখতে আসছেন। পাশাপাশি গাছটি রক্ষার দাবিও জানিয়েছেন তারা। তাদের অভিযোগ, আগে থেকে গাছটির যত্ন না নেওয়ায় এটি উপড়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত কাঠবাদাম গাছটি। জমিদারবাড়ির শান বাঁধানো পুকুরের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত এ গাছের নিচে মধুকবি ছোটবেলায় বসে কবিতা রচনা করতেন। প্রায় ৩০৮ বছর বয়সী কাঠবাদাম গাছটি যেন কবির স্মৃতি ধরে রেখেছিল।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের পরিবারের লোকজন কাঠবাদামতলা ঘাটে স্নান করতেন। মাত্র ১২-১৩ বছর বয়সী মধুসূদন দত্তকে তার বাবা রাজনারায়ণ দত্ত পড়াশোনার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। কবি মধুসূদন দত্ত তার বাবার ইচ্ছায় ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা গমন করেন। সেখানে কবি খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করার পর বজরায় করে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে কাঠবাদামতলায় বজরা ভেড়ান। ধর্ম ত্যাগের কারণে তার জমিদার বাবা কবিকে বাড়িতে উঠতে দেননি। এই কারণে কবি ১৪ দিন এই কাঠবাদাম গাছের নিচে তাঁবু টানিয়ে অবস্থান করেন। ১৪ দিন অবস্থান করার পরও তার বাবা যখন সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেন, তখন কবি কাঠবাদামতলা থেকে প্রায় ৪০০ গজ উত্তরে হেঁটে গিয়ে বজরায় উঠে কলকাতায় পাড়ি দেন। এ কারণে ওই ঘাটটি ‘বিদায় ঘাট’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
সাগরদাঁড়ির ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার শাহাজাহান আলী বলেন, ‘‘কবির স্মৃতিবিজড়িত কাঠবাদাম গাছ ও ‘বিদায় ঘাট’ পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণ হয়ে আছে। কবির ভিটাবাড়িতে আসা দর্শনার্থী অনেকেই কাঠবাদাম পেড়ে খেতেন। আবার তলা থেকে কুড়িয়ে খাওয়া ছাড়াও স্মৃতি হিসেবে কাঠবাদাম গাছের বড় বড় লাল পাতা সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন। পক্ষান্তরে আবার দেখা যায় মধুপ্রেমিক দর্শনার্থী, পর্যটক, পিকনিক পার্টির লোকজন কাঠবাদাম গাছের নিচে ক্লান্তিনাশ ও ছবি তুলতেন।’’
স্থানীয় লেখক শফিক শিমু জানান, অনেক আগের থেকে কাঠবাদাম গাছটি বয়সের ভারসাম্য ধরে রাখতে পারছিল না। ক্রমান্বয়ে তার বড় বড় ডালগুলো মূল গাছ থেকে ভেঙে পড়ত। কালজয়ী কবি নেই, কপোতাক্ষ নদের জোয়ার-ভাটা নেই, ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতার সেই মর্মকথা নেই, যে কারণে পলি জমে মরতে বসেছে নদ। তবুও মহাকবির স্মৃতি আঁকড়ে যুগ যুগ ধরে টিকে ছিল কাঠবাদাম গাছটি। কবির এ স্মৃতি অম্লান করে রাখতে ১৯৪৪ সালে যশোর জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ কাঠবাদাম গাছের পোড়া ইট দিয়ে গেঁথে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। আগের থেকে যদি কৃষি অধিদপ্তর বা বন বিভাগ কাঠবাদাম গাছের ইটের গাঁথনি খুলে গাছের গোড়া পরিচর্যা করতেন, তা হলে গাছটি আরও কয়েক যুগ বেঁচে থাকত।
সাগরদাঁড়ি মধুপল্লীর কাস্টডিয়ান হাসানুজ্জামান বলেন, রবিবার মুষলধারে বৃষ্টির ভেতর ঝড় শুরু হলে কাঠবাদাম গাছটি উপড়ে পড়ে যায়। গাছটি পড়ে যাওয়ার পর থেকে এলাকার মানুষ দেখতে ভিড় করছেন। মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত কাঠবাদাম গাছটি রক্ষার জন্য এলাকার মানুষ দাবি জানিয়েছেন।
যশোর সরকারি এমএম কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান প্রফেসর জিল্লুল বারী বলেন, এখনো কাঠবাদাম গাছটি উদ্যান ও কৃষিবিদদের নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করে বাঁচানো সম্ভব হতে পারে। দ্রুত সময়ে প্রধান মূলসহ অন্যান্য শেকড় ক্ষতি না করে খুব সাবধানে ক্রেন দিয়ে গাছ সোজা করে পরিচর্যা করলে বাঁচতে পারে। উন্নত দেশে এ অবস্থায় গাছ রক্ষা করা হয়।
এইচ আর তুহিন/জোবাইদা/অমিয়/