চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ঝরনাগুলোতে বেড়াতে এসে গত পাঁচ বছরে ১১ পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এ তালিকায় রয়েছেন কর্মজীবীরাও। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসে প্রাণ হারানোর ঘটনায় পর্যটকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বলছেন, উঁচু-নিচু পথের বেশির ভাগ জায়গায় পর্যটকদের নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
অনেক জায়গায় কোনো রকম রশি বেঁধে সংশ্লিষ্টরা দায় সেড়েছেন। টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে তারা যতটা গুরুত্ব দেন, পর্যটকদের দেখভালের বিষয়টি ঠিক ততটাই এড়িয়ে যান। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় দীর্ঘদিন ধরে এভাবে চলে আসছে। যদিও বন বিভাগের পক্ষ থেকে পর্যটকদের অসতর্কতা আর হেয়ালিপনাকে মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছর খৈয়াছড়া ঝরনায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৭ সেপ্টেম্বর সকালে ঝরনায় গোসলে নেমে উপর থেকে পড়া পাথরের আঘাতে মাহবুব হাসান (২৭) নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গাজী আহমেদ বিন (৩৫) নামে আহত একজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আল শাহরিয়ার আনাস (২৪) নামে চুয়াডাঙ্গা থেকে আসা এক মেডিকেল শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া গত ৪ সেপ্টেম্বর খৈয়াছড়া ঝরনা থেকে সিফাতুর রহমান নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে এসে দুদিন নিখোঁজ থাকার পর তার লাশ উদ্ধার হওয়ায় মৃত্যু নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া ওই বছরের ২০ আগস্ট খৈয়াছড়া ঝরণায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে দুজনের মৃত্যু হয়।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জুনে মিরসরাইয়ের ঝরনাগুলোতে কোনো মৃত্যু না হলেও সোনাইচড়ি ঝরনায় এসে ১৫ পর্যটক পথ হারান। পরে তাদের উদ্ধার করা হয়। একই বছরের জুলাইয়ে রূপসী ঝরনা থেকে পড়ে আরিফ (১৮) ও আবছার (১৫) নামে চট্টগ্রামের দুজন মারা যান। সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০২০ সালে খৈয়াছড়া ও নাপিত্তাছড়ায় মারা গেছেন দুজন, আহত হন চারজন। ২০২১ সালে উপর থেকে পড়ে এক পর্যটক মারাত্মক আহত হন। ২০২২ সালে দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয় খৈয়াছড়ায়। এ ছাড়া ২০২২ সালের জুলাইয়ে এই ঝরনা দেখে ফেরার পথে ট্রেন-মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১১ জন।
ঝরনা দেখতে এসে কেন এত মৃত্যু? এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে খবরের কাগজ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিরসরাইয়ের সবচেয়ে সুন্দর খৈয়াছড়া ঝরনা পর্যটকদের পদচারণায় সব সময় মুখরিত থাকে। গত চার বছর ধরে খৈয়াছড়াসহ আরও কয়েকটি ঝরনা যৌথভাবে ইজারা দিচ্ছে বন বিভাগ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, খৈয়াছড়া ঝরনায় পর্যটকদের জন্য কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখা হয়নি। দু-একটি সাইনবোর্ড দেওয়া হলেও বন বিভাগের কোনো টিম সেখানে থাকে না। দীর্ঘ আঁকাবাঁকা অনেকগুলো পথ একসঙ্গে থাকায় সেখানে পথ নির্দেশিকা বা গাইডলাইন থাকা জরুরি। কিন্তু এমন কিছু সেখানে চোখে পড়েনি। কোন পথটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এমন কোনো নির্দেশিকাও রাখা হয়নি। এমনকি উঁচু-নিচু, ঢালু পাহাড়ি পিচ্ছিল পথ হওয়ার পরও কোনো কিছু ধরার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। হালকা রশি দেওয়া হলেও পর্যটকের ভারে সেগুলো বহু আগেই ছিঁড়ে গেছে।
পর্যটকরা জানিয়েছেন, খৈয়াছড়া ঝরনার উপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ে। বানর, ভাল্লুকসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীদের বিচরণ থাকায় সেখানে সব সময় পাথর পড়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু পর্যটকরা যখন কূপে নেমে গোসল করেন তখন তাদের সতর্ক করা হয় না। এখানে যারা ঘুরতে আসেন তারা বেশির ভাগই খৈয়াছড়া সম্পর্কে জানেন না। এ ছাড়াও পাহাড়ি ঢল, প্রবল বৃষ্টিতে এটি বন্ধ রাখা হয় না।
অভিযোগ আছে, মিরসরাইয়ের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবুর রহমান রুহেলের প্রতিষ্ঠান ‘শো মোশন লিমিটেড’ প্রভাব খাটিয়ে ৩০ লাখ টাকায় খৈয়াছড়া ঝরনার ইজারা পান। রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় প্রতিষ্ঠানটি নিয়ম মানতে চাইত না। ইজারা নিয়ে তারা শুধু টিকিট বিক্রি করত। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ঝরনা বন্ধ রাখার কথা থাকলেও তারা খুলে রাখত। এ ছাড়া পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে তারা দোকান বসিয়ে বাণিজ্য করছে।
চট্টগ্রাম থেকে আসা ফজলে রাব্বি নামে একজন পর্যটক বলেন, ‘খৈয়াছড়ায় প্রচুর মানুষ আসে। এখানে নিরাপত্তা বাড়ানো জরুরি। কিন্তু ইজারাদার প্রতিষ্ঠান বা বন বিভাগ সেটি কখনো করে না। অথচ বন বিভাগ প্রতিবছর ইজারার মূল্য বাড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই অনুপাতে কোনো উন্নয়ন হয়নি। ঠিকঠাক একটি রাস্তাও করা হয়নি। পুরোনো রাস্তাও মেরামত করা হয়নি।’
ঢাকা থেকে আসা আরেক পর্যটক বাদশা মিয়া বলেন, ‘খৈয়াছড়া ঝরনায় গাইড নিতে হলে অনেক খরচ করতে হয়। তাই অনেকের পক্ষে গাইড নেওয়া সম্ভব হয় না। ইজারাদার বা বন বিভাগ কী ন্যূনতম দিকনির্দেশনা দিতে পারে না’, প্রশ্ন রাখেন তিনি। অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে ‘শো মোশন লিমিটিড’-এর দায়িত্বে থাকা মাহবুব রহমান রুহেলের ব্যক্তিগত সহকারী আবুল হাসনাতকে একাধিবার কল করা হলেও সংযোগ স্থাপন করা যায়নি। তাই তার মন্তব্য জানা যায়নি।
চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস এম কায়চার বলেন, ‘এ বছর ৩০ লাখ টাকায় কয়েকটি ঝরনা যৌথভাবে ইজারা দেওয়া হয়েছে। আমরা পথে পথে নির্দেশনা দিয়েছি। পর্যটকদেরও বারবার বলা হয় যেন ঝুঁকিপূর্ণ কোনো স্থানে তারা না যান। কিন্তু অতিউৎসাহীরা উপর থেকে লাফ দেন। পিচ্ছিল জায়গায় গিয়ে গড়াগড়ি করেন। এমন অসতর্কতা থেকেই দুর্ঘটনা ঘটে।’ তিনি দাবি করেন, ‘কেবল পর্যটকদের হেয়ালিপনা থেকেই এসব মৃত্যু হয়।’