ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১০টা। রাস্তার ওপর দলবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন যুবক। তাদের এক হাতে লাঠি, আরেক হাতে টর্চলাইট। একই পোশাক পরা যুবকরা একটি মোটরসাইকেল আরোহীর পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাকে গ্রামে ঢুকতে দেন। একই সময় একটি অটোরিকশায় থাকা যাত্রীদের পরিচয় জেনে তাদের গ্রাম থেকে বের হতে দেন।
গত সোমবার রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার হিরাপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় এমন দৃশ্য।
স্থানীয়রা জানায়, গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী হিরাপুর ও বড় কুড়িপাইকা গ্রামে চুরি-ডাকাতি, মাদক ও মানব পাচার বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে গ্রামে বেড়ে যায় অপরিচিত মানুষের আনাগোনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে না থাকায় গ্রামের মানুষ আতঙ্ক ও অস্বস্তিতে পড়েন। এসব অপরাধ ঠেকাতে গ্রামের যুবকরা এক হয়ে পাহারার দায়িত্ব নেন। তারা দুই ভাগে রাত জেগে এখন পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করছেন। এতে গ্রামের মানুষের মাঝে এখন অনেকটা স্বস্তি ফিরে এসেছে।
বড় কুড়িপাইকা গ্রামের মো. মনির হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের পর আমাদের হিরাপুর ও বড় কুড়িপাইকা গ্রামে চুরি, মাদক ও মানব পাচার বেড়ে যায়। এসব অপরাধ ঠেকাতে গ্রামের মুরব্বিসহ আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘চোর ও মাদক নির্মূল করি’ নামে একটি সংগঠন করি। এই সংগঠনের মাধ্যমে পাশাপাশি দুটি গ্রামের শতাধিক যুবক রাত জেগে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব পালন করছি। রাত ১০টা থেকে ফজরের নামাজ পর্যন্ত দুটি দল গ্রামে ঘুরে ঘুরে টহল দেয়।’
বড় কুড়িপাইকা গ্রামের সোহেল নামের আরেক যুবক বলেন, ‘দুটি গ্রামই বর্ডার অঞ্চলে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর হিরাপুর ও বড় কুড়িপাইকা গ্রামে চুরি, মাদক ও মানব পাচারের মতো ঘটনা অনেক বেড়ে যায়। তখন গ্রামের মুরব্বিদের পরামর্শে দুই গ্রামের সবাই মিলে একটা সভা করি। সভায় যুবকদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবকমূলক একটি সংগঠন করা হয়। সংগঠনে থাকা যুবকরা রাত জেগে দায়িত্ব পালন করে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা তিনজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, একাধিক চোর ও মানব পাচারকারীকে ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছি। যত দিন পর্যন্ত এসব অপরাধ বন্ধ না হবে, ততদিন পর্যন্ত আমরা দায়িত্ব পালন করব।’
সংগঠনের হিরাপুর গ্রামের ইব্রাহিম নামের এক যুবক বলেন, ‘চোর ও মাদক ব্যবসায়ীদের যন্ত্রণায় গ্রামবাসী অতিষ্ঠ। রাত হলেই মাদক ব্যবসায়ীরা তৎপর হয়ে ওঠে। গ্রামে প্রতিরাতেই চুরি-ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটেছে। আমরা রাত জেগে দায়িত্ব পালন শুরু করলে চুরি, ডাকাতি এখন অনেক কমে এসেছে।’
বড় কুড়িপাইকা গ্রামের মনির হোসেন বলেন, ‘চোর, মাদক ও মানব পাচারকারীদের ধরতে আমরা একটি সংগঠন করেছি। গ্রামে চুরি বন্ধ করার পাশাপাশি অনেক মাদক ও মানব পাচার কাজে সহায়তাকারীকে ধরে বিজিবির হাতে তুলে দিয়েছি। আমরা অধিকাংশ চুরি ও মানব পাচার বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। গ্রামে অপরাধ নির্মূলে আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাব।’
উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও পল্লি চিকিৎসক জহিরুল আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘গ্রামে চুরি, ডাকাতি, মাদক ও মানব পাচারের মতো অপরাধ অনেক বেড়ে যাওয়ায় মানুষ আতঙ্কে ছিল। গ্রামবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রথমে সবাই ঐক্যবদ্ধ হই। পরে দুই গ্রামের যুবকদের নিয়ে একটি সংগঠন করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে তারা রাত জেগে দায়িত্ব পালন করছে। উৎসাহ দিতে আমিও মাঝে মধ্যে তাদের সঙ্গে রাত জেগে পাহারা দিই। যুবকরা দায়িত্ব পালন করায় উভয় গ্রামেই অপরাধ কমে এসেছে। তাদের এই স্বেচ্ছাসেবকমূলক কাজে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সহযোগিতা করার পাশাপাশি উৎসাহ দিচ্ছেন।’
আখাউড়া থানার পুলিশ পরিদর্শক ও ওসি মোহাম্মদ আবুল হাসিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘চুরি, মাদক ও মানব পাচার প্রতিরোধে সীমান্তের হিরাপুর ও বড় কুড়িপাইকা গ্রামের শতাধিক যুবক মিলে রাত জেগে গ্রাম পাহারা দিচ্ছেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমি মনে করি, সীমান্তের অন্যান্য গ্রামেও যদি এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে দ্রুত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এ ধরনের স্বেচ্ছাসেবকমূলক সংগঠনের জন্য আখাউড়া থানা পুলিশের সহযোগিতা সব সময় অব্যাহত থাকবে।’