সরকারের নির্ধারিত দামে ডিম কিনতে না পারা, রসিদ না দেওয়া, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে জরিমানার কারণে গতকাল সোমবার থেকে ডিম বেচাকেনা বন্ধ রেখেছেন চট্টগ্রামের আড়তদাররা। যতক্ষণ পর্যন্ত না সরকারের নির্ধারিত দামে ডিম কিনতে পারছেন, ততক্ষণ ডিম বেচাকেনা বন্ধ রাখবেন বলে জানিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রামের আড়তদাররা জানান, চট্টগ্রামে ডিমের বড় আড়ত, পাহাড়তলী বাজার। এ বাজারে ১৫ জন আড়তদার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডিম কিনে বিক্রি করে থাকেন। সবচেয়ে বেশি ডিম সংগ্রহ হয় টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলা থেকে। এ ছাড়া রাজধানীর তেজগাঁও থেকেও পাহাড়তলী বাজারে ডিম আসে। এতে প্রতিটি ট্রাকে ১ লাখ ৪৪ হাজার পিস ডিম থাকে। আগে এক গাড়ি ডিম কিনতে খরচ হতো ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। বর্তমানে খরচ হচ্ছে প্রায় ১৮ লাখ টাকা। এত বড় অঙ্কের টাকা জোগান দিতে গিয়ে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। পোলট্রি ফার্মগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে। তারা রসিদে সরকার নির্ধারিত দর দেখালেও বাস্তবে বিক্রি করছেন বেশি দামে। পোলট্রি ফার্ম, আড়ত বা মধ্যস্বত্বভোগীদের আইনের আওতায় না এনে সরকার পাইকারি বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে। তাই প্রকৃত অপরাধীরা রয়ে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
চট্টগ্রাম ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল শুক্কর লিটন খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রতি পিস ডিমের সরকার নির্ধারিত দাম ১১ টাকা ০১ পয়সা। অথচ গত রবিবার আমাদের প্রতি পিস আনতে হয়েছে ১২ টাকা ৮০ পয়সায়। আমরা ওই দামেই ডিমগুলো বিক্রি করেছি। এতে প্রতিটি ডিমে ১০ থেকে ২০ পয়সা লোকসান দিয়েছি। শুধু সরকারি দামে ডিম কিনতে পারছি না বলেই লোকসান গুনতে হচ্ছে। এখানে আমাদের দোষটা কোথায়?’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যাদের কাছ থেকে ডিম সংগ্রহ করি, তারা রসিদ দিতে চায় না। উল্টো তারা বলে, রসিদ ছাড়া নিলে নেন, নইলে নাই। এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযানে এলে আমরা রসিদ দেখাতে পারি না। এর ফলে আমাদের জরিমানা করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত আমাদের সভাপতিসহ আরও দুই ব্যবসায়ীকে বড় অঙ্কের জরিমানা করেছে। এসব হয়রানি থেকে বাঁচতে, আমরা বাধ্য হয়ে ডিম বেচাকেনা বন্ধ রেখেছি।’
পোলট্রি ফার্মের কারণে প্রান্তিক খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, পোলট্রি ফার্মগুলো যেভাবে দাম বাড়ায়, একজন প্রান্তিক খামারি সেভাবে পারে না। এখানে একটা শক্ত সিন্ডিকেট রয়েছে।
এদিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের আড়তদাররা বলছেন, খামারি বিক্রি করার কথা ১০ টাকা ৫৮ পয়সা। কিন্তু এর মাঝে আবার মধ্যস্বত্বভোগী আছে। তাদের কাছ থেকে কেনার পর আমরা বিক্রি করার কথা ১১ টাকা ০১ পয়সায়। কিন্তু আমরাই তো সরকারের নির্ধারিত দামে ডিম বিক্রি করতে পারছি না। এ কারণে আমাদের এখানে গত রবিবার থেকে বেচাবিক্রি বন্ধ রয়েছে।
এ বিষয়ে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমানত উল্লাহ আমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে প্রতি পিস ডিম ১২ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৯০ পয়সায় বিক্রি করেছি। তাই চট্টগ্রামের আড়তদারকে ১৩ টাকার ওপরে বিক্রি করতে হয়। খুচরায় তো দাম আরও বেড়ে যায়। তাই চট্টগ্রামের আড়তদাররা সোমবার থেকে ডিম বেচাকেনা বন্ধ রেখেছেন। এখন সরকারের কাছ থেকে কি ধরনের সিদ্ধান্ত আসে, তারা সেই অপেক্ষায় রয়েছেন।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সারা দেশে দিনে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি ডিমের চাহিদা রয়েছে। বাজারে এখন সবজিসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তি। তাই এখনো মানুষ ডিমের ওপর নির্ভরশীল। ডিমের দাম বেঁধে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এদিকে ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামের আড়তদাররা বেচাকেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডিম বেচাকেনা বন্ধ রাখা তো সমাধান না, এটা অন্যায়। তারা যদি সরকারি দামে ডিম কিনতে না পারে, তাহলে তো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানাতে হবে। এ ছাড়া ‘ডিম কেনার সময় রসিদ দিচ্ছে না’ এমন সমস্যার কথা তারা তো বলে না। বিষয়টি অন্তত ক্যাবকে জানাতে পারত। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা হলে তারা ব্যবসা বন্ধ করে দেবে, এটার অর্থ হলো তারা আইনের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েছে। চট্টগ্রামের আড়তদাররা সরকারকে সহযোগিতা না করে বরং বাধা দিচ্ছে। যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের পাইকারি ডিম ব্যবসায়ীদের বোঝাপড়া অবশ্যই আছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফয়েজ উল্যাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের টিম পাহাড়তলীতে অভিযান পরিচালনা করছে। আমরা বেচাকেনার রসিদে গরমিল পাচ্ছি। বাড়তি দামে ডিম বিক্রির প্রমাণ পাচ্ছি। পাশাপাশি পাহাড়তলীর আড়তদাররা ডিম কেনার সময় রসিদ নিচ্ছেন না, সংরক্ষণ করছেন না। তাই আমরা বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিচ্ছি।’