নিজ এলাকায় এনজিওকর্মী হিসেবে পরিচিত রুনা খাতুন। আশপাশের বিভিন্ন এলাকাতেও একই পরিচয়ে তিনি অনেকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। টার্গেট একটাই, গ্রামের সহজসরল নারীদের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এই নারী ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর কালীবাড়ি এলাকার বাসিন্দা। তিনি একেক এলাকায় নিজেকে একেক এনজিওর মাঠকর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। কখনো সরকারি প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা করপোরেশন, কখনো ইসলামিক ফাউন্ডেশন, আবার কখনো অন্য ভুয়া এনজিওর নাম ব্যবহার করেন। প্রতারণার কাজটি ঠিকঠাকভাবে করতে সঙ্গে রাখেন কিস্তি আদায়ের বই। তার এই ফাঁদে পা দিয়েছেন অনেকে।
সম্প্রতি এই নারীর প্রতারণার কৌশল বুঝতে পারেন চর কালীবাড়ি এলাকার কয়েকজন ভুক্তভোগী। তাদের কেউ ৫০ হাজার, কেউ ১ লাখ, আবার কেউ ২ লাখ টাকা ঋণ নিতে সদস্য ফরমে নাম লিখে টাকা জমা দিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। আবার কেউ জামানত হিসেবে দিয়েছিলেন নগদ টাকা। কিন্তু কয়েক মাস অতিবাহিত হলেও কেউ ঋণ নিতে পারেননি। গ্রামের সহজসরল নারীরা যখন ক্ষিপ্ত তখন নতুন করে অন্য নারীদের সদস্য বানাতে গেলে আটক হন এনজিওকর্মী পরিচয় দেওয়া রুনা। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে প্রতারণার বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি।
সদর উপজেলা ছাড়াও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় রুনার মতো অনেকেই এনজিওকর্মী পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কখনো কখনো তারা ভাড়ায় ছোটখাটো একটি কক্ষ নিয়ে অফিস বানিয়ে নিয়মিত বসেন। চাকচিক্য অফিস দেখে না বুঝেই গ্রামের সহজসরল নারীরা তাদের ফাঁদে পা বাড়ান। কম সুদে ঋণ দেওয়ার নামে ওই নারীদের কাছ থেকে সদস্য ফরম পূরণ বাবদ ৫০০ টাকা নেওয়া হয়। আবার কখনো অগ্রীম ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে পরবর্তী মাসেই ঋণ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু বিভিন্ন টালবাহানা করে কয়েক মাসে ওই এলাকা থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে তারা সটকে পড়েন। ভুক্তভোগী নারীদের তখন কিছুই করার থাকে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভালুকার ভরাডোবা ইউনিয়নের নিশিন্দা গ্রামে ভাড়া বাসায় থেকে একটি ভূঁইফোড় এনজিও পরিচালনা করতেন ত্রিশাল উপজেলার কানর গ্রামের হাসান মিয়া, তার স্ত্রী রুনা, একই উপজেলার আইলদা গ্রামের শাহজাহান মিয়া ও তার স্ত্রী লিপি। তারা সমিতি থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ দেবেন বলে সঞ্চয় বাবদ স্থানীয়দের টাকা জমাতে বলেন। মোটা অঙ্কের ঋণের আশায় জামিনা খাতুন, মলিনা খাতুন, নুরজাহান, ববিতা, মুর্শিদা খাতুন, শরিফা আক্তার, নাসিমা আক্তার ও জোছনা আক্তারসহ অনেকেই সঞ্চয় বাবদ টাকা জমা দিতে থাকেন। চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি সবার সঞ্চয় বাবদ ৮ লাখ টাকা জমা হলে প্রতারক চক্রটি উধাও হয়ে যায়। এ ঘটনায় উপজেলার ভরাডোবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ আলম তরফদারের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া গফরগাঁওয়ে ঋণ দেওয়ার কথা বলে ‘সোশ্যাল বেনিফিট অর্গানাইজেশন’ (এসবিও) নামে একটি ভুয়া এনজিও অর্ধকোটি টাকা নিয়ে উধাও হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পৌর শহরের শিলাসী দপ্তরিবাড়ী এলাকায় অফিস খুলে বসেছিল কথিত এনজিওটি। সবজি ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে তাদের ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার আশ্বাসে সাত শতাংশ হারে সঞ্চয় আদায় করে প্রতারক চক্র। পরে অর্ধকোটি টাকা নিয়ে তারা লাপাত্তা হয়ে যায়। এ ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ দেয় ভুক্তভোগীরা।
নান্দাইলেও ঘটেছে এমন ঘটনা। পৌর এলাকার সুমী হোটেলে দুই ব্যক্তি এনজিওকর্মী পরিচয়ে খাওয়া-দাওয়া করেন। ধীরে ধীরে সখ্য গড়ে তোলেন হোটেলের মালিক সোহেল মিয়ার সঙ্গে। ২০ হাজার টাকা ধার নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান এনজিওকর্মী পরিচয়দানকারী প্রতারক চক্রের ওই দুই সদস্য।
ময়মনসিংহ সদরের চর কালীবাড়ি এলাকার ভুক্তভোগী আসমা খাতুন খবরের কাগজকে বলেন, জীবন বিমা করপোরেশনের নাম ব্যবহার করে রুনা আমার কাছে এসে ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে এজন্য আমাকে ৫০০ টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হবে। এক লাখ টাকা ঋণ পেতে তিনি আমার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা জামানত হিসেবে নেন। কিন্তু কয়েক মাস পার হলেও ঋণ পাইনি। সম্প্রতি আমার পাশের বাড়িতে তিনি অন্য নারীদের সদস্য করতে এলে আমিসহ ভুক্তভোগী কয়েকজন নারী তাকে আটক করি। এ সময় তিনি প্রতারণার বিষয়টি স্বীকার করেন।
দীনা খাতুন নামে আরেকজন বলেন, ‘স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরবে। ঘুচবে অভাব নামের যন্ত্রণা। এমন প্রলোভনে আমাকেও সদস্য করেন রুনা। কিন্তু আমি প্রতারণার শিকার হয়েছি। আমার মতো শতাধিক নারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’
রুনা খাতুনের সঙ্গে কথা হয় খবরের কাগজের প্রতিবেদকের। তিনি প্রতারণার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে বলেন, ‘আমি কোনো এনজিওর নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মী না। সম্প্রতি যারা জানতে পেরেছেন, তারা আমাকে আটকে রেখেছিলেন। পুলিশে দেওয়ার আগ মুহূর্তে টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাসে ক্ষমা চেয়ে ছাড়া পাই।’
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক রাজু আহমেদ বলেন, অনেকে নিবন্ধন ছাড়াই নাম দিয়ে এনজিওর মালিক পরিচয়ে কর্মী নিয়োগ করে টাকা লেনদেন করেন। আবার অনেকে গ্রামের সহজসরল নারীদের টার্গেট করে ঋণ দেওয়ার নাম করে লাপাত্তা হয়ে যান। তাদের সম্পর্কে আমাদের কাছে তেমন তথ্য নেই। তবে কোনো নিবন্ধনকৃত সংস্থার নামে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করা হবে। তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে সংস্থার নিবন্ধন বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।