এককালের প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্র নদ আজ দখলে-দূষণে জীর্ণ-সংকীর্ণ। কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য আর মানুষের ব্যবহৃত মলমূত্র দিনের পর দিন একে দূষিত করে চলেছে। অথচ এসব দেখার কেউ নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শুধু দায়সারা ভূমিকা পালন করছে।
পরিবেশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি মিলগুলোর পরিবেশ দূষণের দায়কে গুজব বলে উড়িয়ে দিলেন। তবে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে দূষণকারীদের সম্পর্কে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেন তিনি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নরসিংদীতে বয়ে যাওয়া নদ-নদীর মধ্যে সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ। নদটি যেন এখন দূষণকারীদের জীবিকা নির্বাহের উপায় হয়ে উঠেছে। এই নদের পাড়ে অবস্থিত কারখানাগুলো এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) রাখলেও তারাই আবার মিলের বিষাক্ত তরল বর্জ্য নদে ফেলছে। প্রতিবাদ করেও কোনো ফল হয়নি। এমনটাই জানালেন পাড়ের বাসিন্দারা।
এই জেলায় আছে সুতা প্রসেসিং মিল, ডাইং মিল, কাপড় রঙের কারখানা, জিগার মেশিন, স্পিনিং মিল, গার্মেন্টসসহ বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এসব কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত তরল বর্জ্য পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদসহ বিভিন্ন ফসলি জমিতে পড়ছে। পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এই নদের সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষজন। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
শিলমান্দী ইউনিয়নের গনেরগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মাহবুব হাসান শুভ বলেন, ‘নদটির ওই পাড়ে কুড়েরপাড় এলাকা; সেখানে কাপড় রং করায় নদটি মৃতপ্রায়। আমরা ছোটবেলায় এই নদীতে গোসল করতাম, মাছ ধরতাম; এখন দূষণের কারণে এর পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা যায় না। আমরা স্থানীয়ভাবে অনেক প্রতিবাদ করেও প্রতিকার পাইনি।’
সরেজমিনে শিলমান্দী ইউনিয়নের কুড়েরপার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ইভা ডাইং নামে একটি মিল থেকে বর্জ্য এসে পড়ছে নদের পানিতে। সাংবাদিক হিসেবে ভিডিও করতে দেখে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করে দেয়। মিলগেটে গিয়ে খোঁজ করলে ইভা ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং লিমিটেডের ইটিপি ইনচার্জ জানান, তারা নদ দূষণ করেন না। সাংবাদিকরা ভুল দেখছেন।
ইটিপি ইনচার্জ মো. রেজাউল জানালেন, মিল মালিকের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। তিনি মিলে সপ্তাহে এক দিন আসেন। বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সর্ম্পক রেখে তারা এ এলাকায় প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে আমরা দূষণ করি না, সামনে গিয়ে দেখেন, সরাসরি বর্জ্য ফেলছে অনেকে। এসময় এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল, ওই এলাকার ফাতেমা ডাইংসহ ব্রহ্মপুত্রের তীরে গড়ে ওঠা মিলগুলো থেকে পানির স্রোতের মতো বর্জ্য এসে নদীতে পড়ছে। কিন্তু এ নিয়ে এসব মিলের কেউ কথা বলতে রাজি হলেন না।
নরসিংদী পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক মো. কামরুজ্জামান সরকার বলেন, আমি গত জুলাইয়ে যোগদান করেই পুরাতন ব্রহ্মপুত্র পরিদর্শন করেছি। নদের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের কিছুই নেই। নেই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ। তিনি জানান, তীরের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বর্জ্য শোধন করে নদে পানি ছাড়ে।
কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে তার কথার কোনো মিল পাওয়া গেল না। অনেকটা দায়সারা কথা বললেন পরিবেশ অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা। এ সময় তিনি দাবি করেন, নরসিংদীতে ১২৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ১১৮টি প্রতিষ্ঠানের পানি শোধন করার ইটিপি রয়েছে। তবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানালেন। কিন্তু এর পরও কী করে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি দূষিত হচ্ছে তার কোনো জবাব তার কথায় পাওয়া গেল না।