‘হামার কপালের দোষ দিমো না নেতালাক দোষ দিমো, বুঝা পাই না। এইলা নাকি দেশের উন্নয়ন হইছে? বছরটা না ঘুরিতে ব্রিজখানের রাস্তাটা ভাঙে যাছে। হামরা এই রাস্তাটা ধরে যাছি আর আল্লাহকে ডাকেছি। একটা কাজ করিলে যদি জনগণের দুর্ভোগ, সমস্যা রহে যায়- তাহিলে ওইখান কাজের দোষ তুমরা কাকে দিবেন কহেন তো। হামার রাস্তাখান বছর ঘুরিতে না ঘুরিতে কেনে ভাঙিল, কোনো ঠিকাদার দায়সারা কাজ করিল আর সরকারের ইঞ্জিনিয়াররা কি চোখত কালা চশমা পরে ছিল? এইলার জবাব দিবা হবে।’
কথাগুলো বলছিলেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নের বাসিন্দা সাইকেল আরোহী সমশের আলী। ওই ইউনিয়নের পাশাপাশি আসাননগর এলাকার হাজারও মানুষের যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করতে ছয় কোটি টাকার বেশি অর্থে এলজিইডির তত্ত্বাবধানে একটি ব্রিজ ও প্রায় এক কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ওই দুই ইউনিয়নের বাসিন্দাদের পুরোনো দুর্ভোগ আবারও ফিরে এসেছে। কারণ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে ব্রিজটির যে সংযোগ সড়ক তৈরি করা হয়েছে তা বছর না ঘুরতেই ভেঙে গেছে। ব্রিজটির অবস্থাও ঝুঁকিপূর্ণ। এতে ওই এলাকার মানুষদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সড়কটি ভেঙে যাওয়ায় ব্রিজটির ওপর দিয়ে এখন কোনো ভারী যানবাহন চলাচল করছে না। গত তিন মাস ব্রিজটি এক রকম অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে সাড়ে ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ব্রিজটি মানুষের কোনো উপকারে আসছে না। বরং সংযোগ সড়কটি এখন পথচারীদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে রাজাগাঁও ইউনিয়নের আসাননগর ও খড়িবাড়ি এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য শহরের পাইকারি বাজারে নিতে বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে। অভিযোগ আছে, সংযোগ সড়কের বেহাল অবস্থা নিয়ে স্থানীয়রা এলজিইডি কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানালেও তারা আমলে নেয়নি।
জানা গেছে, ২০১৯ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ২৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যের পিএসসি গার্ডার ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শুরু করে। এর সঙ্গে প্রায় এক কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে। ব্যয় হয় সাড়ে ছয় কোটি টাকা। কাজটি বাস্তবায়ন করেছেন জামাল হোসেন নামে এক ঠিকাদার। ২০২২ সালের মাঝামাঝি কাজ শেষ হয়। ২০২৩ সালের শেষদিকে ব্রিজটির উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলী সদস্য ও ঠাকুরগাঁও-১ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন।
ব্রিজটি উদ্বোধনের পর কয়েক দফায় সড়কের দেয়াল ব্লকসহ নদীতে ধসে যায়। স্থানীয়রা তখন বালুর বস্তা দিয়ে সাময়িক সংস্কার করে ধস ঠেকায়। কিন্তু এবারের সামান্য বৃষ্টিতে আবারও ব্রিজটির পশ্চিম তীরের সড়কের একটি অংশের ব্লক ভেঙে যায়। এ ছাড়া সংযোগ সড়ক ভেঙে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়। এভাবে কয়দিন থাকার পর স্থানীয়রা বালুর বস্তা ও বাঁশ দিয়ে সংস্কার করে চলাচলের ব্যবস্থা করেন। তবে হেঁটে চলাচল ছাড়া ব্রিজটির ওপর দিয়ে সব ধরনের ভারী যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
আসাননগরের বাসিন্দা বনী হাওলাদারের অভিযোগ, ‘ছোট্ট একটি ব্রিজ আর সাড়ে ৭শ মিটারের রাস্তার কাজে এত টাকা বরাদ্দ হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি, ঠিকাদার এবং এলজিইডি কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় এই কাজ থেকে লাখ লাখ টাকা লুটপাট করেছে। তা না হলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো না।’
রাব্বিল কবির নামে ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা চাই এই ব্রিজ ও রাস্তা নির্মাণ কাজের তদন্ত হোক। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ ও বিভাগীয় দায়িত্বরতরা কাজের মান পরীক্ষা করলেই অর্থ লুটের বিষয়টি বেরিয়ে আসবে।’
এ বিষয়ে জানতে ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। তাই তার বক্তব্য জানা যায়নি। তবে সদর উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল কাদের জানান, এ প্রকল্পের ব্যয় শুরুতে ধরা হয়েছিল পাঁচ কোটি ২৫ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে তা বাড়িয়ে সাড়ে ছয় কোটি টাকা করা হয়। গেল টানা বর্ষণে ব্রিজের কোনো ক্ষতি না হলেও সংযোগ সড়ক ভেঙে গেছে। বিষয়টি আমরা জানি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই সংস্কার করা হবে।
এলজিইডি ঠাকুরগাঁওয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন বিশ্বাস বলেন, ‘ব্রিজটির পাশাপাশি সংযোগ সড়কেরও সংস্কার জরুরি। দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কার করতে আমরা চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে সংস্কারের জন্য ঢাকায় এস্টিমেট (কাজের সম্ভাব্য পরিমাণ ও ব্যয় নির্ণয়) পাঠানো হয়েছে। এখন আমরা বরাদ্দের অপেক্ষায় আছি।’ তবে এ কাজে কোনো অনিয়ম বা অর্থ লুট হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।