ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড। ঘটনাটি গত ২৮ অক্টোবর রাত দেড়টার দিকে। আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত ট্রলিবয় রুহান হোসেন রুপু একজন রোগী নিয়ে ওই ওয়ার্ডে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে হল্লা করেন।
এ সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত এক রোগী লাইট জ্বালাতে নিষেধ করলে ট্রলিবয় রুপু আহত রোগীদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। শুরু হয় কথা-কাটাকাটি। একপর্যায়ে রুপু অন্য ট্রলিবয়দের ডেকে এনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন সোহেল, সাগর, হৃদয়, শামীম এবং নাজমুল নামের ৫ জনকে মারধর করেন। এ ঘটনায় ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক সেনাবাহিনী, পুলিশ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, মহানগর ও জেলা ছাত্রদলসহ ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ ঘটনায় ওয়ার্ড মাস্টার মো. শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে চারজনের নাম উল্লেখ করে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ৪ থেকে ৫ জনকে আসামি করা হয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত রুহান হোসেন রুপু এবং মোশারফ হোসেনকে সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সেবার মান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি, গুড গভর্নেন্স, চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক, টিকিট কাটা থেকে সেবা পাওয়া পর্যন্ত রোগীর কত সময় লাগে, এ রকম কয়েকটি বিষয়ে ৩০০ নম্বরের মধ্যে স্কোরিং করে সেরা প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করা হয়। ফিল্ড ভিজিট এবং রোগীর সাক্ষাৎকারও এই ফলাফলের মূল্যায়নে অন্তর্ভুক্ত হয়। মমেক হাসপাতালটি এসব কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার ফলেই দেশ সেরা হাসপাতালের স্বীকৃতি অর্জন করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে হাসপাতালের সেবা নিয়ে অসন্তুষ্ট রোগীরা। অসাধু কর্মচারীদের দাপটের কাছে জিম্মি তারা। ফলে হাসপাতালের সুনাম ধরে রাখতে অসাধু কর্মচারীদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি রোগীদের।
তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, বৃহত্তর ময়মনসিংহের দুই কোটি মানুষের ভরসাস্থল এই হাসপাতাল। এ ছাড়া গাজীপুর ও সুনামগঞ্জ জেলার মানুষও চিকিৎসা নিতে এই হাসপাতালে আসেন। এক হাজার শয্যার অনুমোদিত লোকবল দিয়ে বাড়তি এসব রোগীর চাপ সামাল দিতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা।
তারপরও চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। রোগী ও তাদের স্বজনদের হয়রানি কিংবা সেবার নামে বাড়তি টাকা নেওয়ার কোনো অভিযোগ এলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কারও কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে প্রয়োজনীয়ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কয়েকজন রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালে ব্যাপক দাপট কর্মচারীদের। বিশেষ করে আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলার সাহসও পাওয়া যায় না। তাদের বেশির ভাগ স্থানীয় হওয়ায় বেশি প্রভাব খাটায়। ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন গ্রাম থেকে আসা রোগীরা। আউটসোর্সিং ছাড়াও অসাধু কিছু স্থায়ী কর্মচারীও সেবা দেওয়ার পর বকশিশ দাবি করেন। বকশিশ না দিলে রোগী ও তাদের স্বজনদের দেখতে অসহযোগী আচরণ।
সদরের চুরখাই এলাকার বয়োবৃদ্ধ মঞ্জু মিয়া পেটে প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া নিয়ে হাসপাতালে আসেন। হেঁটে যেতে খুব কষ্ট হয় তার। সঙ্গে ছিলেন অটোরিকশাচালক ছেলে আলমাস। ট্রলিবয়কে ডাক দিয়ে বলেন, ট্রলিতে করে তার বাবাকে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে। আলমাসকে ট্রলিবয় বলেন, ‘এর জন্য দেড় শ টাকা লাগবে।’ আলমাস খবরের কাগজকে বলেন, ‘তাড়াহুড়ো করে আব্বাকে হাসপাতালে আনছি। লগে যা টাকা আছিন, গাড়ি ভাড়ায় খরচ হয়ে গেছে। হাসপাতালে আইবার পরে লগে টাকা আছিল না। এ জন্য ট্রলিবয়কে টাকা দিবার পারছি না। নিজেই আব্বারে ধইরা ধীরে ধীরে ওয়ার্ডে নিয়ে গেছি।’
ইদ্রিস আলী নামের আরেকজন বলেন, ‘জেলার ফুলপুরের বালিয়া গ্রাম থেকে এসে এক সপ্তাহ ধরে শিশু ওয়ার্ডের মেঝেতে বাচ্চাকে নিয়ে ভর্তি আছি। চিকিৎসক না থাকলে নার্সদের সহযোগিতা নিচ্ছি। নার্সদের ডাক দিলে শিশুর কাছে আসেন অনেকক্ষণ পরে। পরের বার আবারও ডাক দিলে রাগারাগি করেন। এক কর্মচারী বেসরকারি হাসপাতালে চলে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তার কথায় যাইনি। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লিখে দিয়েছিল। ওই কর্মচারী নিজ থেকেই আরেকজন লোকের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট পেয়েছি। এ জন্য কর্মচারীসহ আরেকজনকে ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে।’
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের একজন নার্স বলেন, ‘এই ওয়ার্ডে এখন শিশু রোগীর চাপ আরও বেড়েছে। তবুও আমাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। মাঝেমধ্যে শিশুদের অভিভাবক কিংবা স্বজন একসঙ্গে এসে ডাকাডাকি করেন। তখন প্রথমে একজন অসুস্থ শিশুর কাছে গিয়ে পরে আরেক শিশুকে সেবা দেওয়া হয়। মাঝেমধ্যেই শিশুর অভিভাবক রাগারাগি করলেও আমরা চুপ থাকতে চেষ্টা করি।’
বাড়তি টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে সালাম নামের একজন কর্মচারী বলেন, ‘আমি কখনো কারও কাছ থেকে টাকা নেই না। অন্য কর্মচারী এসব করে কি না, আমার জানা নেই।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ময়মনসিংহের সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, ‘হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা ভালো রাখতে চাইলে সেখানে অনিয়ম ও দুনীতিমুক্ত করতে হবে। হাসপাতালের কারও বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে চাকরিচ্যুতসহ আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবার মান ভালো রাখতে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে। গুটি কয়েক কর্মচারীর জন্য সুনাম নষ্ট হতে দেওয়া হবে না। কোনো কর্মচারী কোনো অনিয়ম করলে কিংবা বাড়তি টাকা নিলে সচেতন রোগী কিংবা তাদের স্বজনদের উচিত আমাদের জানানো। তা হলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে আমাদের সুবিধা হয়। কর্মচারীদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। অনিয়মের প্রমাণ মিললে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’