চট্টগ্রাম মহানগরে ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশের (টিসিবি) ন্যায্যমূল্যে ৪৭০ টাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। দীর্ঘসময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য না নিয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে অনেককে।
আবার সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের রাজনৈতিক নেতাদের পরিচিত কিংবা পছন্দের পাত্র না হওয়ায় লাইনে দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছেন না কেউ কেউ। কারও কাছে আবার ফ্যামিলি কার্ড নেই। কার্ড ছাড়া পণ্য নেওয়া যাবে, সেই নিশ্চিয়তাও দেওয়া হচ্ছে না। আছে প্রচারণার অভাবও। ফলে সরকারি সুবিধায় ন্যায্যমূল্যে বাজার করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এমনটা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগের আমলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতারা টিসিবির পণ্য বিতরণ ও নিয়ন্ত্রণ করতেন। তারাই ঠিক করতেন কে পাবেন, কে পাবেন না। আর এখন এই কাজটি করছেন বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের নেতা এবং নেতাদের ঘনিষ্ঠরা। এতে অনেক সাধারণ মানুষ পণ্য কিনতে পারছেন না। কাউকে কাউকে লাইন থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে।
এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ধরা পড়েছে তাদের বক্তব্যেই। এই প্রতিবেদককে তারা সাংঘর্ষিক বক্তব্য দিয়েছেন।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উপ-পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, বর্তমানে কোনো ডিলার নেই। চসিকের যারা আঞ্চলিক কর্মকর্তা, ওয়ার্ড সচিব, সমাজসেবা অফিসার, পুলিশ কর্মকর্তা আছেন, তারাই দেখভাল করছেন।
নগরের ২০টি পয়েন্টে দৈনিক ৭ হাজার জনকে কার্ড ছাড়া ৪৭০ টাকার পণ্য দেওয়া হয়। এই পণ্যের মধ্যে আছে ৫ কেজি চাল, ২ লিটার তেল, ২ কেজি ডাল। আর দোকানে পণ্য দেওয়া হচ্ছে কার্ড দিয়ে। প্রতিদিন প্রতিটি পয়েন্টে সাড়ে তিন শ জনকে পণ্য দেওয়া হয়। সেই হিসেবে নগরে দৈনিক ৭ হাজার জন পণ্য পাচ্ছেন। ডিলার আছেন ১৩৯ জন। এ ছাড়া কিছু কিছু জায়গায় ট্রাকে পণ্য দেওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে নিতে হচ্ছে কার্ড দিয়ে। তবে নভেম্বরের পরে আর এই সমস্যা থাকবে না বলে জানানো হয়েছে। সবগুলো পণ্য এক নিয়মে দেওয়া হবে। অর্থাৎ কার্ডবিহীন ট্রাক থেকে যে কেউ চাইলে লাইনে দাঁড়িয়ে নির্ধারিত পণ্য কিনতে পারবেন। পণ্য বিতরণে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব খাটানোর অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মো. শফিকুল ইসলাম তা উড়িয়ে দেন।তিনি বলেন, এসব সত্য নয়।
লালদীঘি পাড়ের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরীন ফেরদৌসি খবরের কাগজকে বলেন, আজ রবিবার (১০ নভেম্বর) আমার অধীনে ৪টি ওয়ার্ডে টিসিবির পণ্য দেওয়া হচ্ছে। ১৫টি ওয়ার্ডে এসব পণ্য দেওয়া হবে। টিসিবি থেকে যখন পণ্য ছাড়িয়ে আনা হয় তখন আমরা ডিলারদের প্রত্যয়ন দেই। এভাবে প্রতিদিন কোনো না কোনো ওয়ার্ডে পণ্য দেওয়া হচ্ছে। এক ওয়ার্ডে একাধিক ট্রাকও থাকে। আমরা বিতরণের কাজ নিয়মিতভাবে মনিটর করছি। বর্তমানে কার্ড ছাড়াই পণ্য দেওয়া হচ্ছে। ডিলাররাই পণ্য বিক্রি করছেন। পণ্য বিতরণে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব থাকার কথা তিনি জানেন বলে স্বীকার করেছেন।
তবে উল্টো বক্তব্য দিয়েছেন চসিকের আগ্রাবাদ এলাকার আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা রক্তিম চৌধুরী। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে যারা ডিলার আছেন তারাই পণ্য এনে বিক্রি করছেন। কোনো ফ্যামিলি কার্ড বাতিল করা হয়নি। আগের কার্ড দিয়েই আমার এলাকার ১২টি ওয়ার্ডে পণ্য দেওয়া হচ্ছে। কার্ড বাতিল হওয়া বা ডিলার না থাকার বিষয়টি তিনি জানেন না।
এদিকে কয়েক দিন আগে টিসিবির ৪৩ লাখ কার্ড বাতিল করা হয়েছে, টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবিরের এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে গত শনিবার ঢাকার তেজগাঁওয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এর ব্যাখ্যা দেন। তিনি জানান, ৪৩ লাখ ফ্যামিলি কার্ড বাতিলের খবরটি সঠিক নয়। আমাদের কাছে যে এক কোটি পরিবারের কার্ড ছিল, সেগুলো যখন এনআইডির ডাটাবেজে ভেরিফাই করা হলো তখন দেখা গেল অনেকেই দুইবার কার্ড নিয়েছেন। যে কার্ডগুলোতে সমস্যা ছিল সেগুলোই বাদ পড়েছে। ইতোমধ্যে ৫৭ লাখ কার্ড স্মার্ট করা হয়েছে। বাকিগুলো স্মার্ট করার প্রক্রিয়া চলছে।
এদিকে কয়েকজন ডিলার স্বীকার করেছেন, চট্টগ্রাম নগরে টিসিবির পণ্য বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে অনেককেই বাদ দিতে বলা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডিলার বলেন, আমার ওয়ার্ডে বিএনপির একজন বলে দিচ্ছেন কাকে পণ্য দেব, কাকে দেব না। এ বিষয়ে তাদের নির্দেশনা আছে।
এ কে এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. হেলাল (ডিলার) বলেন, আমরা কার্ড ছাড়াই পণ্য দিচ্ছি। কাদেরকে দেওয়া হবে আগে থেকে তার একটি সিরিয়াল করা হয়। সেই সিরিয়াল অনুসারে পণ্য দিচ্ছি। একাধিকবার পণ্য নেওয়া ঠেকাতে অনেক ডিলার আইডি কার্ড দিয়ে পণ্য দিচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
গত শনিবার (৯ নভেম্বর) নগরের কাজির দেউড়ি এলাকায় শাহবুদ্দিন নামে একজন বলেন, তাকে লাইন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। যিনি বের করে দিয়েছেন তিনি একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। শাহাবুদ্দিন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও পণ্য পাননি। এ ছাড়া একজন নারীকে পণ্য না নিয়ে ফিরে যেতে দেখা যায়। জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, কার্ড ছাড়া দেওয়া হচ্ছে খবর পেয়ে তিনি লাইনে দাঁড়ান। কিন্তু তাকে পণ্য দেওয়া হয়নি। মনের দুঃখে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। এত নিয়ম মেনে পণ্য নেওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন।
মো. মহিউদ্দিন নামে একজন পথচারী খবরের কাগজকে বলেন, আগের মতোই মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আগে একদল নিয়ন্ত্রণ করত এখন আরেক দল। পরিবর্তন আর হইল কই?
জানতে চাইলে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নাজিমুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, আমাদের কোনো নেতা-কর্মীর টিসিবির পণ্য বিক্রিতে প্রভাব খাটানোর কথা আমি শুনিনি। কারা করছে, কী করছে তাও আমার জানা নেই। তবে আমি শুনেছি আগে একেকজন ব্যক্তি দশটা কার্ড দিয়ে একাধিকবার পণ্য নিত। এখন সেটি যাতে না হয়, প্রকৃত সাধারণ মানুষ যাতে পণ্য পায়, সে জন্য আমাদের অনেক নেতা-কর্মী সহযোগিতা করছেন।