
‘ছেলেকে নিয়ে আমাদের পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। আশা ছিল সে একদিন আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবে। আর আজীবন বিনামূল্যে আইনি সেবা দেবে অসচ্ছল ও গ্রামের দরিদ্র মানুষদের। তারও স্বপ্ন ছিল একদিন মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে যাবে। কিন্তু চিন্ময়ের উগ্রবাদী অনুসারীরা আমার ছেলে ও আমাদের পরিবারের সব স্বপ্ন ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল।’ বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন- চট্টগ্রাম নগরীতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারীদের হামলায় নিহত অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের বাবা মো. জামাল উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘ছাত্রজীবনে আমার ছেলে অত্যন্ত মেধাবী ছিল। আমাদের পরিবারের সবার ইচ্ছে অনুযায়ী, সে এলএলবি পাস করে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। তার ভাই ও আত্মীয়-স্বজনদের স্বপ্ন ছিল সে একদিন পরিবারের সবার মুখ উজ্জ্বল করবে। তবে সেটি আর হলো না। তাকে অচিরেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হলো। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে, আমি বেঁচে থাকতে তাদের বিচার দেখে যেতে চাই।’
জামাল উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চুনতি ইউনিয়নের ফারাঙ্গা এলাকায়। তবে তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে উপজেলার দরবেশহাট রোডের টেন্ডালপাড়ায় থাকেন।
জামাল ও হোসনে আরা দম্পতির পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সাইফুল আলিফ ছিলেন চতুর্থ। বাকি চার ভাই প্রবাসে থাকেন এবং দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
জানা যায়, ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন সাইফুল আলিফ। তিনি লোহাগাড়ার আধুনগর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেন। পরে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) থেকে এলএলবি পাস করে চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশায় যুক্ত হন।
আরও জানা যায়, প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে লোহাগাড়া সদর ইউনিয়নের সওদাগরপাড়ার ইসরাত জাহান তারিনের সঙ্গে বিয়ে হয় সাইফুল ইসলামের। তাদের মাসুরা ইসলাম তাসকিয়া নামে একটি আড়াই বছরের মেয়েসন্তান রয়েছে। এ ছাড়া তার স্ত্রী ইসরাত সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। দ্বিতীয় সন্তানের মুখ দেখার অপেক্ষায় ছিলেন আলিফ-তারিন দম্পতি। তবে অনাগত সন্তানের মুখ দেখার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো আলিফকে।
আলিফের বড়বোন জান্নাত আরা বেগম বলেন, ‘আমার ছোট ভাই সাইফুলের ঘরে ছোট্ট একটা মেয়ে রয়েছে। তার সেই মেয়েটি এখনো অপেক্ষায় বসে আছে, তার বাবা শহর থেকে তার জন্য খেলনা নিয়ে আসবে। তবে তার বাবা যে আর ফিরে আসবে না, সেটি তাকে কীভাবে বুঝাব আমরা? আমাদের পরিবারের স্বপ্নগুলো ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। আমাদের স্বপ্নগুলো যারা ভেঙেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
অ্যাডভোকেট সাইফুলের প্রতিবেশী পানত্রিশা গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আলিফ একজন নম্র-ভদ্র ছেলে ছিল। এলাকার সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। বছরখানেক আগে আমাদের পাশের গ্রাম পুঁটিবিলার মহিউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি চট্টগ্রাম শহরে চাকরি করতেন। সেখানে থাকার সময় চট্টগ্রামের একটি মামলায় তার নাম জড়িয়ে যায়। আলিফ বিনা খরচে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তাকে আদালত থেকে জামিন করান। তার মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।’
সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুণ্ডরিক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন আবেদন ঘিরে মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) চট্টগ্রাম আদালত ও তার আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে চিন্ময়ের অনুসারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় অ্যাডভোকেট সাইফুলকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে চিন্ময়ের অনুসারীরা।
বুধবার (২৭ নভেম্বর) আলিফের মরদেহ বাড়িতে নেওয়ার আগে চট্টগ্রাম শহরে দুটি জানাজা হয়। একই দিন দুপুর দেড়টার দিকে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় লোহাগাড়া উপজেলায়। লোহাগাড়া শাহপীর পাইলট হাই স্কুল মাঠে আলিফের তৃতীয় জানাজা শেষে মরদেহ তাদের গ্রামের বাড়ি ফারাঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে লতাপীরের মাজারসংলগ্ন জামে মসজিদের মাঠে চতুর্থ জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
পপি/