শেরপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খামারিরা প্রাণিসম্পদ বিভাগের বিনামূল্যের চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। সরকারি সেবা পেতে হলে তাদের বাড়তি টাকা গুনতে হয়। বাধ্য হয়ে তারা স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকের কাছ থেকে সেবা নিচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে সরকারি সেবা না পাওয়ায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, সঠিক পরামর্শ ও সহযোগিতার অভাবে অনেক নতুন খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কেউ কেউ আবার খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। রয়েছে ভ্যাকসিনেরও সংকট। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যেন না ঘটে, সে জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ঝিনাইগাতী উপজেলার আকলিমা খাতুন। স্বামীর মৃত্যুর পর সাত ছেলে-মেয়ের সংসারের হাল ধরতে কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। সিদ্ধান্ত নেন গবাদিপশু পালন করবেন। পরে গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি লালন-পালন শুরু করেন। ছোট পরিসরে শুরু করলেও আজ তার শতাধিক হাঁস ও কিছু গরু-ছাগল আছে। কিন্তু এই দীর্ঘসময়ে অনেক পশু ও হাঁস-মুরগি অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে তাকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে। কিন্তু কেন হিমশিম খেয়েছেন আকলিমা, এ বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমার একশর বেশি হাঁস আছে। এগুলোর পাশাপাশি ১০টি ছাগল আর পাঁচটি গরু পালন করি। কিন্তু এগুলো অসুস্থ হলে কখনো সরকারি চিকিৎসা পাইনি। সরকারি ডাক্তার কোনোদিন চোখেও দেখিনি। কোনো পশুর অসুখ হলে অন্তত দুই মাইল রাস্তা হেঁটে বাচ্চারা ওষুধ নিয়ে আসে। বিপদ যেহেতু আমাদের, আমাদেরকেই কিছু করতে হবে।’
শুধু আকলিমা খাতুন তা নয়, জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের প্রান্তিক খামারিদের প্রায় সবারই একই অভিযোগ। খামারিরা জানান, সরকারি সেবা নিতে গেলে তাদের নানা ধরনের হয়রানি পোহাতে হয়। পশু হাসপাতালে ভ্যাকসিনের জন্য গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। কোনো সময় ডাক্তারকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি কিংবা খামারে আনতে গেলে বাড়তি টাকা গুনতে হয়।
ঝিনাইগাতী উপজেলার খামারি জাকির মিয়া বলেন, ‘প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনগুলো সঠিক সময়ে পাওয়া যায় না। কিছুদিন আগে পশু চিকিৎসকদের বলছিলাম, আমাদের এলাকায় গরুর বাতনা রোগ বাড়ছে। ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন। পরে ডাক্তাররা বললেন, ১৫ দিন পর ভ্যাকসিন আসবে। এর পর দুই মাসের বেশি সময় হয়েছে, ভ্যাকসিন আর আসেনি। আমাদের গরুগুলো ভ্যাকসিন ছাড়াই থাকল।’
তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে এই রোগে আমাদের এলাকায় তিনটি গরু মারা গেছে। যদি ভ্যাকসিনগুলো দিত, তা হলে হয়তো গরুগুলো মারা যেত না।’
রুবেল মিয়া নামে ওই এলাকার আরেক খামারি বলেন, ‘আমাদের গৃহপালিত পশু নিয়ে সরকারিভাবে কোনো তদারকি করা হয় না। পল্লী চিকিৎসক ছাড়া যদি প্রাণিসম্পদ বা ওই অফিসের কোনো লোকজনকে আমরা আনতে যাই, তাদের বাড়তি টাকা দিতে হয়। কমপক্ষে ১৫০০, কখনো তিন হাজার টাকাও দিতে হয়। তারা এসে বলেন, আমরা সরকারি ডাক্তার। তাই এভাবেই দিতে হবে।’
শ্রীবরদী উপজেলার খামারি আবু মিয়া বলেন, ‘আমরা গ্রাম্য মানুষ। সাধারণত হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল লালন-পালন করি। কিন্তু এগুলো অসুস্থ হলে আমরা সরকারি কোনো ডাক্তার পাই না। সরকারিভাবে কোনো সহায়তাও পাই না। অসুস্থ হলে স্থানীয় বাজারের পল্লী চিকিৎসকের কাছেই যেতে হয়।’
শ্রীবরদী উপজেলার হারিয়াকোনা এলাকার খামারি রহমান মিয়া বলেন, ‘আমার একটি মুরগির খামার ছিল। সেখানে কয়েক প্রজাতির মুরগি পালন করেছি। কিন্তু ভ্যাকসিন নিতে না পারায় অনেক মুরগি মারা যায়। এর কিছুদিন পর খামারটি বন্ধ করে দিয়েছি।’
খামারি আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘আমার খামার থেকে প্রাণিসম্পদ অফিস ১৪ কিলোমিটার দূরে। ভেবে দেখুন, অসুস্থ গরু নিয়ে ওই অফিসে যেতে আমার কত টাকা ভাড়া লাগবে? আমার মতো ছোট খামারির পক্ষে এত টাকা খরচ করা সম্ভব নয়।’
শেরপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এবিএম আব্দুর রউফ বলেন, ‘কোনো ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়েও যদি পশু অসুস্থ হয়, তা হলে আমাদের ভেটেরিনারি টিম যেতে বাধ্য। আমার এমনই নির্দেশনা দেওয়া আছে। বিশেষ করে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফিল্ডে যদি নাও যান, ভেটেরিনারি সার্জন অবশ্যই ফিল্ডে যাবেন। জনগণের জন্য ভেটেরিনারি সার্জন সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকবেন। সেটা হোক অফিস কিংবা বাইরে। ভবিষ্যতে এ ধরনের সমস্যা যেন না হয়, সে জন্য আমি প্রতিটি উপজেলায় দিকনির্দেশনা দিয়েছি।’