সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে বাঙ্কারের নিরাপত্তায় ফিরেছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি)। গত ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর নিরাপত্তাহীনতায় আরএনবিকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এই সুযোগে দফায় দফায় রোপওয়ে বাঙ্কার লুটপাট চলে। এ নিয়ে খবরের কাগজে দুটি সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সর্বশেষ গত ১০ ডিসেম্বর খবরের কাগজে ‘রেলের জমিতে হরিলুট’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পরের দিনই আরএনবি মোতায়েন করা হয়। এর আগে গত ২০ অক্টোবর খবরের কাগজে ‘ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে বাঙ্কারের পাথর সাবাড়’ শিরোনামে একটি সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত বুধবার তাদের আবার বাঙ্কারের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বেলা সাড়ে ১১টায় ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের (বাঙ্কার) সংরক্ষিত এলাকায় যান ঢাকা ডিভিশনাল রেলওয়ের ম্যানেজার মো. মহিউদ্দিন আরিফ, আরএনবি চট্টগ্রামের চিফ কমান্ড্যান্ট মো. আসাবুল ইসলাম, প্রধান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। তাদের সঙ্গে প্রশাসনের পক্ষে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবিদা সুলতানা ও কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আল মাহমুদ আদনান, বিজিবির কালাসাদেক বিওপির কোম্পানি কমান্ডার প্রমুখ। এর আগে একটানা দুই দিন মাইকিং করানো হয়।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবিদা সুলতানা আরএনবি সদস্যদের আবার দায়িত্বের বিষয়ে বলেছেন, বাঙ্কারের নিরাপত্তায় তারা বুধবার থেকে মাঠে থাকবেন। এখন সেখানে থাকার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় আপাতত বাইরে থেকে তারা দায়িত্ব পালন করবেন। এর মধ্যে তাদের বাঙ্কারে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, সিলেটের ভোলাগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জের ছাতক পর্যন্ত রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের একমাত্র রোপওয়ে (রজ্জুপথ)। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির পাশে রোপওয়ের লোডিং স্টেশনের বাঙ্কার এলাকা পড়েছে। পাথর পরিবহনে স্থল কিংবা জলযানের বিকল্প হিসেবে ১৯৬৪ সালে ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতকে রজ্জুপথ স্থাপন করা হয়। ১১৯টি খুঁটির মাধ্যমে তৈরি হয় রোপলাইন। এর মধ্যে আছে ভোলাগঞ্জ লোডিং স্টেশন (বাঙ্কার) ও ছাতক খালাস স্টেশন। বাঙ্কারের ৩৫৯ একর জমি, অবকাঠামোসহ রেলের স্থাপনা, যন্ত্রপাতি দেখভাল করতে ২০০০ সাল থেকে আনসার বাহিনী দায়িত্বে ছিল। তবে আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও বিক্রির অভিযোগ উঠে।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে রেল মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আনসার বাহিনীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দায়িত্ব নেয় রেলওয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী আরএনবি। একজন পরিদর্শক ও দুজন উপপরিদর্শকের নেতৃত্বে ৪৮ সদস্যের আরএনবি দল সার্বক্ষণিক অবস্থান করে পাহারায় নিয়োজিত করা হয়েছিল।
গত ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর সংরক্ষিত ওই এলাকা থেকে রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি) সরিয়ে নেওয়া হয়। এ সুযোগে শুরু হয় পাথর লুট। দিনে ও রাতে বাঙ্কার খোঁড়াখুঁড়ি করে পাথর তোলা হয়। এতে করে ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনা হুমকির মুখে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে বিজিবিকে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাতেও বদলায় না দৃশ্যপট। বাঙ্কার খুঁড়ে পাথর তোলা চলতেই থাকে।
গত বৃহস্পতিবার এসব লুটপাটের চিত্র দেখতে সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের উপদেষ্টা দপ্তরের ৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল। পরিদর্শক দল প্রতিনিধি দল সূত্র জানায়, ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে সংরক্ষিত বাঙ্কার এলাকার ৩৫৯ একর জায়গার মধ্যে তিন শতাধিক এলাকায় খোঁড়াখুঁড়ি অবস্থায় পেয়েছে পরিদর্শক দল। সেখান থেকে প্রায় শত কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। এসব পাথর বোল্ডার। উত্তোলিত বা আমদানি করা পাথরের চেয়ে বোল্ডার পাথরের দাম বেশি হওয়ায় দফায় দফায় লুটপাট হয়েছে। বাঙ্কারের সমতল অংশ যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি করায় সেখানকার বালু ও পাথর কোয়ারির ধলাই নদ অববাহিকা অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
বাংলদেশ রেলওয়ে প্রতিনিধি দলের পক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ মো. আজমাইন মাহতাব পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, লোহাজাতীয় মালামাল বেশি লুট হয়েছে। এতে করে রোপওয়ের যন্ত্রাংশ প্রায় ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ৫ আগস্টের পর লুটপাটের পর দ্বিতীয় দফায় বিচ্ছিন্নভাবে আরও প্রায় ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। সব মিলিয়ে রেলসম্পদ ও পাথর লুট হয়েছে দেড় শ কোটি টাকার।