কুমিল্লা জেলায় প্রায় তিন হাজার একর জায়গাজুড়ে পাহাড় রয়েছে। এর মধ্যে লালমাই পাহাড় অন্যতম। প্রত্নসম্পদে ভরপুর ঐতিহ্যেবাহী এ লালমাটির পাহাড় কেটে প্রতিদিনই নতুন নতুন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিনোদন কেন্দ্র, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়িসহ নানান স্থাপনা। ফলে পাহাড়টি এখন অস্তিত্ব হারানোর শঙ্কায় পড়েছে।
পাহাড় কেটে বনভূমি ধ্বংসের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন, বন বিভাগ এবং পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা ও আইন প্রয়োগের দাবি করে এলেও স্থানীয়রা বলছেন, প্রকাশ্যে ও লুকিয়ে পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকায় অনেক পাহাড়ি জায়গা সমতলে পরিণত হয়েছে। কখনো রাজনৈতিক প্রভাবে, কখনো আবার প্রশাসনিকভাবেও লালমাই পাহাড়ের মাটি অবাধে কাটা হয়; যা এখনো চলমান রয়েছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিবেশ রক্ষায় বনভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। পাশাপাশি এগুলো জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি দেশের মোট জমির কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি দরকার, সেখানে আমাদের দেশে রয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ। নির্বিচারে পাহাড় কাটায় এর পরিমাণ দিনদিন আরও কমছে। কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের মাটি কাটা বন্ধে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে এই পাহাড় একসময় অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে। আর এর প্রভাব পড়বে জীববৈচিত্র্যের ওপর।
জানা গেছে, কুমিল্লার সদর, সদর দক্ষিণ ও বরুড়া উপজেলায় অবস্থিত এ পাহাড় উত্তর-দক্ষিণে ১১ মাইল (১.৬০ কিলোমিটারে এক মাইল) লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে দুই মাইল চওড়া। লাখ লাখ বছর আগের এই লালমাই পাহাড় কেটে এবং বন উজাড় করে বিগত দুই দশক ধরে নির্মাণ করা হয়েছে কাশবন নামে দুটি পার্ক ও রিসোর্ট, ব্লু ওয়াটার পার্ক, লালমাই লেকল্যান্ড, ডাইনোসর পার্ক, ম্যাজিক প্যারাডাইস। নির্মাণ প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও বেশ কিছু বিনোদনকেন্দ্র। পাহাড়ের টিলা কেটে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি সিসিএন বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা ফিজিক্যাল কলেজসহ নির্মাণ করা হয়েছে বহু সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাও।
পরিবেশপ্রেমীরা বলছেন, এ পাহাড়ের অধিকাংশ জমি ব্যক্তিমালিকানাধীন হওয়ায় স্থানীয়রা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মাটি কেটে বনভূমি উজাড় করছেন। এভাবে জুলুম আর লোভের কোপে ধীরে ধীরে ছোট হচ্ছে লালমাই পাহাড়। বিলুপ্ত হচ্ছে জীবজন্তু, নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। পরিবেশপ্রেমীদের দাবি, ইতিহাস ও প্রকৃতি রক্ষায় এ পাহাড় সংরক্ষণ জরুরি।
মাহবুবুর রহমান নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, ‘গত কয়েক বছরে কুমিল্লার লালমাই পাহাড় থেকে যে পরিমাণ মাটি কাটা হয়েছে তা চলমান থাকলে আগামী ১০ থেকে ১২ বছর পর আমরা এই পাহাড় আর দেখতে পাব না। এক সময় এ পাহাড়ে উঠলে কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন স্থাপনা দেখা যেত। এখন যে যার ইচ্ছামতো পাহাড় কাটছে। বিক্রি করছে। পাহাড় কাটা বন্ধে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এই পাহাড়কে আর রক্ষা করা যাবে না।’
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. সোহরাব উদ্দিন বলেন, ‘পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ছাড়াও এ অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির জন্য লালমাই পাহাড়ের গুরুত্ব অপরিসীম। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উচিত সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে প্রত্নসম্পদে ভরপুর এ পাহাড় রক্ষায় সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয়দের মাঝে পাহাড়ের গুরুত্ব তুলে ধরা।’
কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র কেমিস্ট রায়হান মোর্শেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিনোদন কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরিতে পাহাড় কাটার অভিযোগ রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর এসব অভিযোগের ভিত্তিতে চলতি বছর চারটি মামলা করেছে। বিভিন্ন সময় অভিযান চালানো হচ্ছে।’
বন বিভাগের কুমিল্লা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জি এম মোহাম্মদ কবির খবরের কাগজকে বলেন, ‘পাহাড় কাটার দায়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কেও ছাড় দেওয়া হয়নি। মামলা ও আইন প্রয়োগ করা হয়েছে। বনবিভাগের সম্পত্তি দখল, মাটি কাটা ও বনভূমি ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে কখনই ছাড় দেওয়া হবে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, ব্যক্তি পর্যায়ে যতটুকু পাহাড় কাটা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি কাটা হয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। তাদের কারণে পাহাড় ও বনভূমি বেশি ধ্বংস হচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠান করার আগে সংশ্লিষ্টদের তিনি পাহাড় ও বনভূমির জায়গা বাদ দিয়ে অন্য জমি বাছাইয়ের পরামর্শ দেন।