চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বিখ্যাত ‘ভান্ডারি মুলা’র জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। দেশজুড়ে রয়েছে এ মুলার চাহিদা। প্রতিটি মুলার ওজন হয় ৫ থেকে ১৪ কেজি পর্যন্ত। আকারে বিশাল এবং স্বাদে অসাধারণ। স্থানীয়ভাবে এটি ‘ভান্ডারি মুলা’ নামে পরিচিত হলেও এর জাত আসলে জাপানের।
ফটিকছড়িতে অবস্থিত মাইজভান্ডার দরবার শরিফের প্রতিষ্ঠাতা হজরত আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ওরশ ১০ মাঘ (২৪ জানুয়ারি) উপলক্ষে আগত আশেকভক্ত জায়েরনি ও দর্শনার্থীদের কাছে এই মুলার চাহিদা অত্যন্ত বেশি। এ সময় স্থানীয় কৃষকরাও মুলা বিক্রির জন্য অপেক্ষা করেন। দরবারে আগত ভক্ত-অনুরক্তরা এ মুলা রোদে শুকিয়ে দীর্ঘদিন রেখে তবারুক হিসেবেও খান বলে প্রবাদ আছে। ফটিকছড়ির হালদার চরে জমে থাকা পলি-বালি মিশ্রিত জমিতে বিশাল আকারের এ মুলার উৎপাদন হয়।
এদিকে এ কৃষি ফসল নিয়ে রীতিমতো শুরু হয়েছে গবেষণা। মুলা কেন এ বিশাল আকারের হয়? অন্য কোনো উপজেলায় হয় না কেন? দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর চাষাবাদ কীভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, এর জন্য গবেষণা চালানো হচ্ছে।
ভান্ডারি মুলার খেত ঘুরে দেখা গেছে, এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। শুক্রবার মাইজভান্ডার দরবারের ওরশ। আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে বিক্রি শুরু হবে এটি। চলবে শনিবার পর্যন্ত। তাই বুধবার সকালে খেত থেকে তোলা হচ্ছে মুলা। খেতে দেখা যায়, কৃষকদের মধ্যে কেউ মুলার ঝুঁটিতে সুতা বাঁধছেন, কেউ পানিতে মুলাকে ধুয়ে পরিষ্কার করছেন। আর কেউ মুলাকে সড়কের পাশে নিয়ে স্তূপ করে রাখছেন। প্রতিটি মুলার ওজন ২ থেকে ১২ কেজি পর্যন্ত হয়।
নাজিরহাট পৌরসভা, সুন্দরপুর, সুয়াবিল ইউনিয়নসহ হালদা নদীর অববাহিকায় চাষিরা এই মুলা উৎপাদন করেছেন। তাদের খেতগুলো দেখে মুগ্ধতা জাগে। খেতের মুলা তোলার জন্য শ্রমিকদের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজনও যোগ দিয়েছেন। খেত থেকে তুলে নিয়ে মুলা নাজিরহাট ঝংকার মোড় থেকে মাইজভান্ডার দরবার শরিফ পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে পসরা সাজিয়ে বিক্রি করা হয়।
একেকটি মুলা ৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। তবে চাষিরা জানান, উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে মুনাফা আগের মতো হচ্ছে না। অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেছেন। তবে মুলার আকার ও চাহিদার কারণে কৃষকরা আশাবাদী, ওরশে ভালো দাম পাবেন।
কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলাল হোসেন জানান, এ মুলার সর্বোচ্চ ওজন ১২ থেকে ১৫ কেজি হয়ে থাকে। বর্তমানে ২ থেকে ১০ কেজি ওজন পর্যন্ত মুলা হয়েছে। সাধারণত এত বড় মুলা দেশের আর কোথাও উৎপাদন হয় না। এই মুলার নাম ‘জাপানি হাইব্রিড তাসাকিসান’ মুলা।
ফটিকছড়ির মাইজভান্ডারে বিক্রি হয় বলে স্থানীয়রা নাম দিয়েছেন ‘ভান্ডারি মুলা’। হাইব্রিড জাতের এই মুলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া হালদা নদী, ধুরুং ও সর্তাখালের বিস্তীর্ণ চরে উৎপাদিত হয়। বিশেষ করে নাজিরহাট পৌরসভা, সুয়াবিল, সুন্দরপুর, বৃহৎ কাঞ্চননগর দিয়ে বয়ে যাওয়া হালদা, ধুরুংখাল এবং খিরাম দিয়ে বয়ে যাওয়া সর্তাখালের চরাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে কৃষিকাজ। এসব এলাকায় ভান্ডারি মুলার চাষ হয়ে থাকে।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, এবার হালদার চরে ৫০ হেক্টর জমিতে মুলার চাষ হয়েছে। প্রতিবছরের অক্টোবর থেকে ভান্ডারি মুলা রোপণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। উৎপাদনে বিভিন্ন দেশীয় সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে এই মুলার চাষাবাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত কৃষকরা। এক অজ্ঞাত রোগের কারণে উৎপাদিত অনেক মুলা নষ্ট হচ্ছে। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন অনেক চাষি। কৃষিসংশ্লিষ্টদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন চাষিরা।
এর আগে রহস্য উন্মোচনে ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি হাটহাজারীর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের একদল বিজ্ঞানী ফটিকছড়ির সুয়াবিল ও সুন্দরপুর ইউনিয়নের হালদার চর পরিদর্শন করেছিলেন। ওই কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম হারুনর রশীদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘মুলার জাত ও মাটির গুণাগুণের কারণে হালদার চরে বৃহৎ আকারের মুলা উৎপাদন হয়। কৃষকদের কাঠোর পরিশ্রম, যথা সময়ে সার-কীটনাশকের সঠিক ব্যবহারে এই মুলার আকৃতি বড় হচ্ছে। মাঘ মাসের ওরশকে কেন্দ্র করে আয়ের লক্ষ্য স্থির করে চাষিরা ওই মুলার পেছনে সময় দিচ্ছেন বলেই উৎপাদন আশানুরূপ হচ্ছে। তবে এ মুলা নিয়ে গবেষণা চলমান রয়েছে।
নাজিরহাট পৌরসভার সুয়াবিলের নাইচ্চ্যরঘাটের হালদা চরের কৃষক মুহাম্মদ সোহেল বলেন, ‘আমি তিন কানি (১২০ শতাংশ) জমিতে ভান্ডারি মুলা চাষ করেছি। এবার খেতে পাঁচ হাজার পিস মুলা উৎপাদন হয়েছে। লক্ষ্য হচ্ছে, সব খরচ বাদ দিয়ে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা লাভ হবে। প্রবাস ছেড়ে এসে মুলার চাষ করছি।’
ফটিকছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান বলেন, ‘চরের মাটি খুবই উর্বর এবং উৎপাদিত ফসল অত্যন্ত পুষ্টিকর। চলতি বছর ভান্ডারি মুলার বাম্পার ফলন হয়েছে। এটি চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। এবার কৃষকরা ভালো দাম পাবেন এই মুলা বিক্রি করে।’