
অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে এসেছেন কৃষক সেকেন্দার মিয়া। রোগীর মুখে অসুখের বিবরণ শুনে কোনো ওষুধ না দিয়েই শারীরিক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাকে পাঠানো হয় বেসরকারি প্যাথলজিতে। বলা হয়, এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা পপুলার অথবা সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করাতে হবে।
যশোরের অভয়নগর থেকে আসা দরিদ্র ওই কৃষক হাসপাতালের সামনের একটি ক্লিনিক থেকে ৩ হাজার টাকা দিয়ে পরীক্ষা করালেও চিকিৎসক সেই রিপোর্ট দেখতে আপত্তি জানান। নির্দিষ্ট করে নাম বলে দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর যেকোনো একটি থেকে তাকে আবারও নতুন করে পরীক্ষা করে আনতে বলা হয়। এতে অসহায় পরিবারটি বিপাকে পড়েন। একইভাবে খুলনার তেরখাদা থেকে আসা রোগী রনজিতা সাহাকে উপশম ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও রূপসা থেকে আসা ইদ্রিস সানাকে সিটি ইমেজিং সেন্টার থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে বলা হয়।
জানা গেছে, কিছু চিকিৎসক নির্দিষ্ট ওই সব প্যাথলজি-ক্লিনিকের সঙ্গে কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়েছেন। ফলে সরকারি হাসপাতালে প্যাথলজি সুবিধা থাকলেও রোগীদের নির্দিষ্ট ক্লিনিকগুলোতে পাঠানো হয়। এভাবে খোলামেলা কমিশন বাণিজ্যের কারণে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে ভোগান্তিতে পড়েন ভুক্তভোগীরা।
অন্যদিকে মনিটরিংয়ের অভাবে সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে বহির্বিভাগে রোগীর ভিড় বাড়লেও দায়িত্বরত চিকিৎসকরা আসেন দুপুর ১২টার পর। তাদের অধিকাংশই প্রেসক্রিপশনে কোনো ধরনের ওষুধ লেখা ছাড়াই নির্দিষ্ট ক্লিনিকের নাম উল্লেখ করে রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বেসরকারি প্যাথলজিতে পাঠিয়ে দেন। দুপুরের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওই রিপোর্ট পেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আর দুপুরের পর ওই চিকিৎসক চেম্বারেও থাকেন না। ফলে ওই রিপোর্ট দেখাতে খুলনায় থাকতে হয় রোগী ও তার স্বজনদের। এতে তাদের বাড়তি অর্থ ব্যয় হয়।
জানা গেছে, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে কেন্দ্র করে এর আশপাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই দালালদের মাধ্যমে রোগীদের প্রলোভন দেখিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে চলছে টেস্ট বাণিজ্য।
সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে কমিশন পাচ্ছে দালাল চক্র। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানে মানসম্পন্ন প্যাথলজি বিভাগ, ডিপ্লোমাধারী প্যাথলজিস্ট নেই। ফলে তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন আছে।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, খুলনা নগরীতে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ২৫০টি। মাঝে মধ্যে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে হাসপাতাল-ক্লিনিকে অভিযান চালানো হলেও তা বন্ধ হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকের পাশাপাশি আউটসোর্সিং হিসেবে হাসপাতালে ওয়ার্ড বয়, আয়া, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তা প্রহরী ও মালি পদে কর্মরত কর্মচারীরাও রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কমিশন সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনা জেলা শাখার সম্পাদক অ্যাডভোকেট কুদরত-ই খুদা বলেন, সরকারি ভবন, স্থাপনা, যন্ত্রপাতি ও লোকবল ব্যবহার করে বেসরকারি ক্লিনিকগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা মাধ্যমে কমিশন বাণিজ্য চালাচ্ছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) খুলনার জেলা সভাপতি ডা. বাহারুল আলম জানান, যারা কমিশন বাণিজ্যে জড়িত তারা অবশ্যই অন্যায় করছেন। তবে সরকারি হাসপাতালে প্যাথলজির সুযোগ বাড়াতে হবে। সেখানে জনবল, টেকনোলজিস্টের ঘাটতি আছে। সরকারি হাসপাতালের প্যাথলজির সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হলে অনিয়ম বন্ধ হবে।