
খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের দুপুরের খাবারে ৯৫ গ্রাম করে মুরগির মাংস দেওয়ার কথা। কিন্তু তাদের দেওয়া হয় ২২ থেকে ২৫ গ্রামের মতো। ভালোমানের চিকন চালের ভাত দেওয়ার কথা থাকলেও পাতে মেলে মোটা চালের ভাত। প্রতিদিনই খাতা-কলমে ১৩০০-১৪০০ রোগীর হিসাব থাকে। কিন্তু খাবার দেওয়া হয় এক হাজারের মতো রোগীকে। সরকারি হাসপাতালে রোগীর খাবার থেকে এভাবে বছরে হাতিয়ে নেওয়া হয় কয়েক কোটি টাকা।
রোগীরা জানান, হাসপাতালে রোগীদের সকালে ডিম, কলা, চারপিস পাউরুটি দেওয়া হয়। দুপুরে পাঙ্গাস মাছ, মৃগেল বা ব্রয়লার মুরগির যেকোনো এক পিস, ডাল, সবজি ও রাতে ভাত, ডিম, ডাল দেওয়া হয়। রোগীদের অভিযোগ, নিম্নমানের চালের ভাত, স্বাদহীন হলদে পানির মতো ঝোলও পরিমাণে কম দেওয়া হয়। হাসপাতালে কোনো চার্ট না থাকায় প্রতিদিন কোন খাবার দেওয়ার কথা তাও তারা জানেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী নামে-বেনামে বছরের পর বছর রোগীর খাদ্য সরবরাহে ঠিকাদারির কাজ করেন। এর সঙ্গে জড়িত হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাও। নানা শর্তের বেড়াজালে নতুন ঠিকাদাররা এখানে খাবার সরবরাহের কাজ পান না।
জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরে খুমেক হাসপাতালে নির্দিষ্ট কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খাবার সরবরাহ করছে। তাদের মধ্যে কাজ ভাগাভাগি করেছেন মহানগর যুবলীগের শীর্ষ এক নেতা। প্রভাব বিস্তার করে হাসপাতাল থেকে ওই কাজগুলো তিনি হাতিয়ে নিতেন। তারপর চারটি ক্যাটাগরিতে ঠিকাদাররা তাকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিয়ে কাজ ভাগাভাগি করে নিতেন।
খুমেক হাসপাতালের হিসাবরক্ষক ওম্বিকা দাস খবরের কাগজকে বলেন, হাসপাতালে ক্যাটাগরি-১ এ চাল, ডাল, তেল, ক্যাটাগরি-২ তে মাছ, মাংস, ক্যাটাগরি-৩ এ দুধ, পাউরুটি, কলা ও ক্যাটাগরি-৪ এ মসলা সরবরাহ করেন ঠিকাদাররা। প্রতি অর্থবছরে রোগীর খাবার বাবদ সাত থেকে আট কোটি টাকা ব্যয় হয়। খাবার সরবরাহের আগেই প্রতিদিন যাচাই করার কথা। তবে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয় কি না, জানি না।
জানা গেছে, হাসপাতালের রান্নাঘর থেকে প্রতিদিনই খাবার চুরি হচ্ছে। গত ২৪ ডিসেম্বর হাসপাতালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানে রান্নাঘর থেকে খাবার চুরির প্রমাণ মেলে। ওই দিন রান্নাঘর থেকে চার কেজি মুরগির মাংস, ৪৯টি ডিম, আট পাউন্ড রুটি, কয়েকটি লাউ, দুই পলিথিন ভর্তি ভাত, দুই কেজি চাল, পেঁয়াজ, শুকনো মরিচ, কলা, তেল, ডাল নিয়ে পালানোর সময় একজনকে আটক করা হয়। এগুলো রোগীদের খাবার হিসেবে ছিল কিন্তু রোগীদের না দিয়ে চুরি করা হচ্ছিল।
দুদকের খুলনা কার্যালয়ের উপপরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ জানান, ১৩৩৫ জনকে খাবার দেওয়ার কথা থাকলেও রান্না করা মুরগির পিস পাওয়া যায় ১০৯৪টি। প্রতি পিস মাংসের ওজন হওয়ার কথা ৯৫ গ্রাম। কিন্তু মাংসের পিস মেপে দেখা যায় ওজন চার ভাগের ১ ভাগ। ভালো মানের চিকন চালের ভাত দেওয়ার কথা থাকলেও রান্না করা ভাত ছিল মোটা চালের।
তিনি বলেন, প্রতিদিন খাবারের নমুনা পরীক্ষার নিয়ম আছে। নমুনা হিসেবে যে খাবার পাঠানো হচ্ছিল, তার মান ভালো। কিন্তু রোগীদের যে খাবার দেওয়া হচ্ছিল, তা নিম্নমানের ও পরিমাণে অল্প। খাবারের নমুনা পরীক্ষার জন্য এক পিস মাংস দেওয়ার কথা। কিন্তু পরীক্ষা করানোর কথা বলে কর্মচারীরা রান্নাঘর থেকে ২০-৩০ জনের খাবার নিয়ে যাচ্ছিল, যা অনিয়ম। এসব ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরেই চারটি ক্যাটাগরিতে এস কে ট্রেডার্স, আলহাজ এ রহমান অ্যান্ড সন্স, আল মামুন ট্রেডিং ও মজমল বাহারাইন নামের চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খাবার সরবরাহের কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও মহানগর যুবলীগের একজন শীর্ষ নেতা খাবার সরবরাহ সিন্ডিকেটে জড়িত। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের কর্মচারীরা প্রতি অর্থবছরে খাবার সরবরাহ দরপত্রে বিভিন্ন শর্ত যুক্ত করে দেন। ফলে সাধারণ ঠিকাদাররা এই দরপত্রে অংশ নিতে পারেন না।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. নুরুল ইসলাম বলেন, রান্নাঘরে অসংগতিগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি। এর মধ্যে একজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুদকের খুলনার উপপরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ জানান, এখন থেকে প্রতি সপ্তাহের খাবারের চার্ট ওয়ার্ডে টানানোর জন্য বলা হয়েছে।