মিথ্যা পরিচয় দিয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ভূমিপল্লী আবাসন এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) নেতা আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি। চট্টগ্রামের মাছ ব্যবসায়ী পরিচয়ে তিনি সেখানে বসবাস করছিলেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক টানে কথা বলায় তিনি যে রোহিঙ্গা নাগরিক, স্থানীয়রা তা বুঝতে পারেননি। গত সোমবার (১৭ মার্চ) গভীর রাতে র্যাব আতাউল্লাহকে ওই এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, চার মাস আগে আতাউল্লাহ ভূমিপল্লীতে এসে প্রথমে ভবনের তিনতলায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। অন্য একজন ব্যক্তি এসে বাড়ির মালিক হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি জানান, তার এক আত্মীয় নতুন বাসা ভাড়া নিতে চান। তিনি চট্টগ্রামের মাছ ব্যবসায়ী। হুমায়ুন কবির ওই ব্যক্তির পরিচয়ে বিশ্বাস করে তাকে বাসা ভাড়া দেন। কিছুদিন পর বাড়ির মালিক আতাউল্লাহর কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) চাইলে তিনি সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। দেড় মাস পর জানান, ছোট ফ্ল্যাটে তার কষ্ট হচ্ছে, তাই তিনি আটতলায় বড় ফ্ল্যাটে উঠতে চান। পরবর্তী সময়ে আতাউল্লাহর স্ত্রী, সন্তান ও ভাইকে নিয়ে আটতলায় ২০ হাজার টাকা ভাড়ার একটি ফ্ল্যাটে উঠে বসবাস শুরু করেন।
ওই ফ্ল্যাটের মালিক ইতালিপ্রবাসী। তার অবর্তমানে কেয়ারটেকার আতাউল্লাহকে বাসা ভাড়া দেন। গত ১৭ মার্চ রাত ৩টার দিকে র্যাব ওই ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে আতাউল্লাহকে গ্রেপ্তার করে। ওই বাড়ির বাসিন্দারা জানান, আতাউল্লাহ সাধারণ জীবনযাপন করতেন। অনেকে তাকে অসুস্থ মনে করতেন। লাঠির ওপর ভর দিয়ে চলাফেরা করতেন। আবার কখনো অন্যের সাহায্য নিয়ে হাঁটতেন।
গ্রেপ্তারের পর আতাউল্লাহ ও তার পাঁচ অনুসারীকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, ‘র্যাবের দায়ের করা মামলায় তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসবে।’
আতাউল্লাহ যেভাবে আলোচনায় আসেন
২০১৭ সালে প্রথম আলোচনায় আসেন আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি। ওই বছরের ২৫ আগস্টের পর মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) ওপর হামলার দায় স্বীকার করে তিনি অনলাইনে পরিচয় দেন। ওই হামলায় বিজিপির ৭১ জন সদস্য নিহত হন বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়। সেখানেই তিনি নিজেকে আরসার প্রধান বলে দাবি করেন।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আতাউল্লাহ পাকিস্তানের করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। পরে তারা সৌদি আরবের মক্কায় বসবাস শুরু করেন। আতাউল্লাহ মক্কা ও রিয়াদে ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং শিক্ষকতা করেন। ২০১২ সালে মায়ানমারের রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু হলে তিনি সৌদি আরব ত্যাগ করে রোহিঙ্গা প্রতিরোধ গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৩ সালে তিনি আরসার প্রধান হন।
২০১৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) জানায়, আতাউল্লাহ পাকিস্তানে তালেবানের অধীনে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং লিবিয়াতেও সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকতে পারেন। তার নেতৃত্বে ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর মায়ানমারের পুলিশ পোস্টে হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই হামলায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বড় ধরনের হামলার পর মায়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালায়। এতে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
২০২৩ সালে আরসার শীর্ষ নেতা নূর কামাল ওরফে সমিউদ্দিনের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিব্বুল্লাহকে হত্যা করার নির্দেশও আতাউল্লাহ দিয়েছিলেন। ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পের এক বৈঠকে মুহিব্বুল্লাহ হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ১২ জনের একটি দল তার কার্যালয়ে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে। মুহিব্বুল্লাহ রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনের পক্ষে ছিলেন।
র্যাবের ভাষ্যে, এ কারণে মুহিব্বুল্লাহর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল আরসা। এ ছাড়া বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানে ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা (স্কোয়াড্রন লিডার) রিজওয়ান রুশদী হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি আতাউল্লাহ।
মাহফুজ/