
খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল একসময় চরমপন্থি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। চাঁদাবাজি, খুন, হত্যার হুমকিসহ অপরাধমূলক নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে চরমপন্থিদের সম্পৃক্ততা ছিল। একপর্যায়ে তারাই আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন।
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে হত্যা-পাল্টা হত্যার ঘটনায় আতঙ্কের জনপদ হয়ে ওঠে খুলনা। তবে বিভিন্ন সময় সরকারের সাধারণ ক্ষমা ও পুলিশ-র্যাবের অভিযানে চরমপন্থি কয়েকজন শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হলে অন্যরা আত্মগোপনে চলে যান। ওই অবস্থাতেও পূর্বশত্রুতার জেরে কয়েকজনকে পাল্টা হত্যার ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ গত ৯ জানুয়ারি কক্সবাজারে ‘টার্গেট কিলিংয়ের’ শিকার হন খুলনা সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপু। তার হত্যাকাণ্ডের পর চরমপন্থিদের নিয়ে পুরোনো আলোচনা নতুন করে শুরু হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, খুলনার দৌলতপুর, ফুলতলা, ডুমুরিয়া, রূপসা, দিঘলিয়া ও যশোরের অভয়নগর, কেশবপুর এলাকায় ছিল চরমপন্থিদের অবাধ বিচরণ। ১৯৯০ সালের দিকে দৌলতপুর এলাকার গাজী কামরুল ইসলাম বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলেন। শুরুর দিকে তার অনুসারী ছিলেন নিহত গোলাম রব্বানী টিপু ও শেখ শহীদুল ইসলাম ওরফে হুজি শহীদ। দৌলতপুরের আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন আকতারুজ্জামান খোকন ওরফে টাইগার খোকন। তার অন্যতম ক্যাডার ছিলেন শাহীন ওরফে বড় শাহীন।
১৯৯৪ সালে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন হন আকতারুজ্জামান ওরফে টাইগার খোকন। এতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালে সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে গাজী কামরুল আত্মসমর্পণ করেন। প্রায় ১৭ বছর কারাভোগের পর ২০১৩ সালে তিনি জামিনে মুক্ত হন।
এদিকে ২০১৫ সালের ৩০ অক্টোবর দৌলতপুরে খুন হন গাজী কামরুলের অনুসারী শেখ শহীদুল ইসলাম ওরফে হুজি শহীদ। ওই হত্যা মামলায় গোলাম রব্বানী টিপুকে প্রধান আসামি করা হয়। মামলায় টিপুকে সম্পৃক্ত করার পেছনে গাজী কামরুলের জড়িত থাকার বিষয়টি জানতে পারলে টিপুর সঙ্গে কামরুলের দূরত্ব তৈরি হয়। হুজি শহীদ হত্যা মামলার আরেক আসামি দিঘলিয়া এলাকার চরমপন্থি নেতা জুলকার নাঈম মুন্না। ২০২২ সালের ৩০ জুন খুলনার মুজগুন্নী এলাকায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একইভাবে ৯ জানুয়ারি ‘টার্গেট কিলিংয়ের’ শিকার হন গোলাম রব্বানী টিপু।
স্থানীয়রা জানান, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর কারামুক্ত হন চরমপন্থি নেতা রিফুজি মঈন ও আসলাম ওরফে ট্যারা আসলাম। এ ছাড়া দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকার পর এলাকায় ফিরেছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী টাইগার খোকনের সহযোগী শাহীন ওরফে বড় শাহীন। তাদের সহযোগীরাও এলাকায় ফিরে রীতিমতো ত্ৰাস সৃষ্টি করে।
নিহত টিপুর ঘনিষ্ঠজনরা জানান, ৫ আগস্টের পর পুরোনো সন্ত্রাসীরা এলাকায় ফিরতে শুরু করলে টিপু আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন তিনি ঢাকা ও কক্সবাজারে আত্মগোপনে থাকেন। এর আগে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়েও পুরোনো চরমপন্থিদের একটি অংশের সঙ্গে গোলাম রব্বানী টিপুর দূরত্ব তৈরি হয়। হত্যাকাণ্ডের পর ওই অংশের দিকেই আঙুল তুলছেন টিপুর পরিবারের সদস্যরা।
টিপুর বাবা গোলাম আকবর বলেন, ‘কক্সবাজারে টিপুর কোনো শত্রু নেই। খুলনার শত্রুরাই কক্সবাজারে গিয়ে টিপুকে হত্যা করেছে।’ তবে ওই সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে তিনি খোলাখুলি কিছু বলতে রাজি হননি।
এদিকে চরমপন্থিদের নতুন করে উত্থানের ঘটনায় জেলার বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়াচ্ছে জানিয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, খুলনার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘৫ আগস্টের পর অনেক চরমপন্থি এলাকায় ফিরেছে। কারা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে এসব গোয়েন্দা নজরদারিতে আনতে হবে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে আরও সক্রিয় হতে হবে।’
তবে খবরের কাগজের কাছে নিজেদের সক্রিয়তার তথ্য তুলে ধরেন দৌলতপুর থানার ওসি মীর আতাহার আলী। বলেন, ‘টিপু হত্যাকাণ্ডের পর তদন্তে বিভিন্ন বিষয় সামনে এসেছে। এসব বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। র্যাবের একাধিক টিমও হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কাজ করছে। এলাকায় চরমপন্থিদের আনাগোনা নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।’
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (উত্তর) আবুল বাশার মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, কক্সবাজারে টিপুর হত্যার সঙ্গে খুলনার যোগাযোগ আছে কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া চরমপন্থি দলের সদস্যরা নতুন করে সক্রিয় হচ্ছে কি না, তা-ও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটালে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।